গণিকাবৃত্তি কি করে চলছে?
ইকতেদার আহমেদ
গণিকাবৃত্তির অপর নাম পতিতাবৃত্তি। গণিকা বা পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিতরা নিজ দেহ নিয়ে ব্যবসা করেন। আর তাই এটিকে দেহব্যবসাও বলা হয়। দেহব্যবসা অর্থ- নিজ দেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন। দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা বিরোধী। এ ব্যবসাটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। পৃথিবীর সকল ধর্ম শাস্ত্রে দেহব্যবসাকে বড় ধরনের পাপ বলা হয়েছে। দেহব্যবসা জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর বিধায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের মূলদ- আইন দ-বিধিতে দেহব্যবসাকে সরাসরি অপরাধ বলা না হলেও এ অপরাধটি গণউৎপাতের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এটি দ-বিধির অধীন একটি অপরাধ। তাছাড়া আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর যেকোনো কাজ নিষিদ্ধকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আর তাই গণিকাবৃত্তি বিষযে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে গণিকাবৃত্তি নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অভ্যুদ্বয় পূর্ববর্তী বাংলাদেশের অনেক জেলা শহরে পতিতালয় ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলার কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি পরবর্তী বিগত চার যুগেরও অধিক সময় ধরে বিভিন্ন শহর হতে পতিতালয় উচ্ছেদ করা হলেও এখনো কিছু কিছু শহরে প্রশাসন ও পুলিশের জ্ঞাতসারে পতিতালয় চালু আছে।
পতিতালয় উচ্ছেদ বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত এ কাজটি করার পূর্বে অবশ্যই এ পেশার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ পতিতালয় উচ্ছেদ পরবর্তী পতিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করায় বর্তমানে দেশের অভিজাতসহ সাধারণ আবাসিক হোটেলে এবং বিভিন্ন অভিজাত ও আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাটে এ ব্যবসাটি চালু রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন বস্তিতেও এ ব্যবসাটি ছড়িয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে পতিতাদের তিন ধরনের খদ্দের রয়েছে। এর একটি হলো বিত্তশালী, অপর দুটির একটি অভ্যাসগতভাবে পরনারীর প্রতি আসক্ত এবং অপরটি শ্রমিকশ্রেণি। বিত্তশালীরা সাধারণত আবাসিক হোটেল বা আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন ফ্ল্যাটে যে দেহব্যবসা চলে সেখানে গিয়ে তাদের জৈবিক কাজ সমাধা করেন। অধূনা এ পেশায় চিত্র ও নাট্য জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কেউ উঁচু আয়ের মানসে জড়িয়ে পড়েছেন। সমাজের বিত্তশালীরাই এদের খদ্দের। ইদানিং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়–য়া অনেক শিক্ষার্থী এ পেশাটির সঙ্গে দুঃখজনকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে আবার কেউবা বিলাসিতার বাড়তি ব্যয় মিটানোর প্রয়োজনে এ পথে পা বাড়িয়েছেন। এদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিত্তশালী ছাড়া অভ্যাসগতভাবে যারা পরনারীর প্রতি আসক্ত তারাও এদের খদ্দের। শ্রমিকশ্রেণি বা শ্রমজীবী মানুষরা যেসব শহরে পতিতালয় আছে সেখানে অথবা বস্তিতে গিয়ে তাদের যৌন চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
বর্তমানে আমাদের দেশে কোন কোন জায়গায় বিভিন্ন ছদ্মাবরণে এ ব্যবসাটি চলছে এবং কারা পতিতা হিসেবে এ ব্যবসাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও কারা এদের খদ্দেরের যোগানদাতা এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্যক ওয়াকিবহাল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক এদের বিরুদ্ধে কদাচিৎ তাদের অভিযান পরিচালিত হয়। আবার এমনও দেখা যায় অভিযান পরিচালনার আগেই পূর্ব সংকেত দেওয়ায় অভিযান ফলপ্রসূ হয় না। আর দুয়েকটি ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হলেও পতিতা বা খদ্দের বা যোগানদাতা হিসেবে যাদের আটক করা হয় এদেরকে ৫৪ ধারায় কোর্টে চালান দেওয়া হয়। উক্ত ধারায় চালান প্রাপ্তরা মুচলেকা দিয়ে যৎসামান্য জরিমানা প্রদানপূর্বক বেরিয়ে আসে। এদের অনেকেই আবার পূর্ব পেশায় ফিরে যায়।
আমাদের সংবিধানে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ বিষয়ে রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলার কারণে রাষ্ট্রের জন্য এ পেশায় যেন কেউ নিয়োজিত হয়ে এটিকে জীবিকার বাহন হিসেবে না নেয় সেটি নিশ্চিতকরণ অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় বাস্তবতা হলো রাষ্ট্র সেটি নিশ্চিতে এখনো ব্যর্থ।
পৃথিবীর যে সকল দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃত সেসব দেশে পতিতাদের নিয়মিত নির্ধারিত সময়অন্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোনো পতিতার মধ্যে যৌন সংক্রামক জীবাণু বা ব্যাধি পাওয়া গেলে তাকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হওয়া বা আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত এ পেশায় পুনঃ ফিরে আসতে দেওয়া হয় না। আমাদের সংবিধানে যেহেতু এ ব্যবসাটি নিষিদ্ধ তাই আমাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংবিধানে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু ব্যবসাটি চালু আছে সেহেতু এ ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের মাধ্যমে যেন কোনো যৌন ব্যাধি যেমন সিফিলিস, গণেরিয়া প্রভৃতির বিস্তার না ঘটে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকা উচিত।
আমাদের জনসংখ্যার ৯০ ভাগের অধিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পৃথিবীর ধর্মমতসমূহের মধ্যে ব্যভিচার, দেহব্যবসা বা যৌনতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান সবচেয়ে কঠোর। একজন ব্যাভিচারীর জন্য ইসলামে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে সেটি হলো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু নেই। ব্যাভিচার বা যৌনতার জন্য ইসলাম যে সাজা অনুমোদন করে সেটি আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গণিকা বা পতিতাবৃত্তি জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকার জন্য হানিকর হওয়ার কারণে এটির বিস্তার যেকোনো সমাজ ও দেশের জন্য অস্বস্তিদায়ক ও ক্ষতিকর। আর তাই সংবিধানের চেতনার আলোকে গণিকা বা পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণরূপে নিরোধ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকর উদ্যোগ এবং দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের ঐকান্তিক সহায়তা অত্যাবশ্যক।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান