লক্ষ্মীপুরের নারিকেলে লাখো মানুষের জীবিকা
জাহাঙ্গীর হোসেন লিটন, লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের নারিকেল ব্যবসায়ী তারেক মাহমুদ সুজন। বছর কয়েক আগেও সংসারের অভাব যাকে তাড়া করে বেড়াতো। বেকারত্ব ছিল নিত্যসঙ্গী। ঠিক তখনই সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করেন নারিকেল বেচা-কেনা। ব্যবসায় লাভবান হওয়ায় পরবর্তিতে পুঁজি বাড়িয়ে নারিকেল সংগ্রহ করে বিভিন্ন জেলায় চুক্তিতে সরবরাহ শুরু করেন। পাশাপাশি নারিকেলের ছোবড়া প্রক্রিজাতকরণ কারখানা দিয়ে কর্মসং¯’ান করেছেন ৩০ জন শ্রমিকের। তারা এখানে দৈনিক ও মাসিক মজুরি হিসেবে কাজ করে পরিবারে এনেছেন স্বচ্ছলতা। নারিকেল ও ছোবড়া ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন ¯’ানে সরবরাহ করে প্রতিবছর প্রায় ৩ কোটি টাকার ব্যবসা করেন তিনি। এতে সংসারের অভাব দূর করে, বর্তমানে সুজন লক্ষ্মীপুরের একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত নারিকেল ব্যবসায়ী। নারিকেল ব্যবসায়ী সুজনের মত লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজারের নারিকেল ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ও শষি বাবু। পৃথকভাবে ১৫-১৬জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে নারিকেল ও ছোবড়ার বেচাকেনায় প্রতি বছরই তাদের কোটি টাকা লাভ করে আসছেন। শুধু ওরা তিনজনই নয়, উৎপাদন থেকে শুরু করে নারিকেল ও ছোবড়া ব্যবসায় লক্ষ্মীপুরে প্রায় দেড় লাখ পরিবার জড়িত। এতে প্রায় একশ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে লক্ষ্মীপুরে। উপকূলীয় এ জেলায় নারিকেল ভিত্তিক শিল্প-কারখানা ¯’াপিত হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে আরো গতিশীল হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, লক্ষ্মীপুর জেলার ৫ উপজেলায় ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে নারিকেল বাগান। এসব বাগানে গড়ে ১১ লাখ ১৮ হাজার নারিকেল গাছ রয়েছে। প্রতি গাছে ৫০টি করে গড়ে ৫ কোটি ৫৯ লাখ পিচ নারিকেল উৎপাদন হয়। যার বাজার মুল্য একশ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এছাড়াওলক্ষ্মীপুরে নারিকেলের ছোবড়া বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে দশ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করে থাকে এখানকার ব্যবসায়ীরা। সরেজমিনে জানা যায়, জেলায় নারিকেলের সবচেয়ে বড় হাট বসে সদর উপজেলার দালাল বাজারে। নারিকেল বেচাকেনা ও ছোবড়া বের করার কাজে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে এ বাজারকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও সদরের চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারী, রায়পুর উপজেলার খাসের হাট, মোল্লার হাট, মিতালীবাজার, হায়দরগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলা, কমলনগর উপজেলার হাজির হাট ও রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার নারিকেলের জন্য প্রসিদ্ধ। বর্তমানে এসব হাট-বাজারে কেনা-বেচায় ব্যস্ত সময় পার করছেন নারিকেলের পাইকারসহ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এখানকার নারিকেল খুলনা, বাগেরহাট, ভৈরব, খাদেমগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ফরিদপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।
ব্যবসায়ীরা জানায়, লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত নারিকেল সু-স্বাদু ও তৈলের গুণগত মান ভালো। চাষীদের কাছ থেকে এক জোড়া নারিকেল ৪০-৫০ টাকা ধরে সংগ্রহ করেন তারা। প্রতি বাজার থেকে নারিকেল জেলাবাসীর চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।
এ ছাড়াও প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া তুলে শ্রমিকরা পান ১ টাকা করে, এতে তারা দৈনিক এক হাজার নারিকেল ছোবড়া তোলার কাজ করেন। আবার মাসিক ৪-৫ হাজার টাকা মুজরি হারে শ্রমিকদের দিয়ে নারিকেল ছোবড়া পক্রিয়াজাত করা হয়। প্রক্রিয়াকৃত প্রতি বান্ডিল (১০০ কেজি) ছোবড়া ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। প্রতি মাসে ১০০ বান্ডিল ছোবড়া সরবরাহ করা হয় জাজিম, সোপা কারখানাসহ বিভিন্ন জেলায়।
নারিকেলে ব্যবসায়ী তারেক মাহমুদ সুজন, জাকির হোসেন ও শশি বাবু জানান, এ মৌসুমে তারা প্রতি পিস নারিকেল ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে প্রায় ১৫ লাখ ৪০ হাজার টি নারিকেল প্রায় তিন কোটি টাকায় কিনেছেন। এগুলো কয়েকটি জেলায় পাঠানো হবে। নারিকেল ব্যবসায়ী আকবর ব্যাপারী জানান, এ মৌসুমের প্রতি সপ্তাহে দালাল বাজার থেকে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার নারিকেল দেশের বিভিন্ন ¯’ানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
রামগঞ্জ পৌরসভার শহরের ব্যবসায়ী জাহের বলেন, আমাদের এ অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে নারিকেল গাছ লাগানো হয়। পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরও বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। নারিকেলভিক্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তুললে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়ে বেকার সমস্যা কিছুটা লাঘব হবে।
লক্ষ্মীপুর পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু নোমান চৌধুরী জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার সাড়ে ৪ লাখ কৃষি পরিবারের মধ্যে প্রায় ২ লাখ পরিবার নারিকেল ব্যবসার সাথে জড়িত। তাছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রায় ২৫০টি নারিকেল বাজার রয়েছে। এসব বাজারে জমজমাট ভাবে নারিকল কেনা-বেচা চলে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতি বছরে একশ কোটি টাকারও অধিক নারিকেল উৎপাদন হয়ে থাকে লক্ষ্মীপুরে। তাছাড়া নারিকেলের ছোবড়া বিক্রি করেও ব্যবসায়ীর হচ্ছেন লাভবান। এতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ অঞ্চলে নারিকেল ভিক্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলে কৃষকরা যেমন লাভবান হতো, তেমনি গতিশীল হতো দেশের অর্থনীতি। সম্পাদনা: মুরাদ হাসান