এঞ্জয়িং দ্য বনানী শো?
বনানী ইজ স্টিল গোয়িং স্ট্রং। আমার ধারণা আরও কিছুদিন বাঙালি এই নিউজ খাবে। আর দিলদার সাহেব যেভাবে নিত্যনতুন ডায়ালগ মারছেন, তাতে খবরটা দিনদিন উপাদেয় হয়ে উঠছে। ‘জোয়ান পোলা একটু আধটু আকাম তো করবই…’ ডায়ালগটা এখন বাজার মাতাচ্ছে। সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে মায়ের বক্তব্য। সেখানে আবার ইমোশনাল টাচও আছে, টিপিক্যাল বড়লোক স্বামীর হাতে নিগৃহীত স্ত্রী। সো, ভাল মার্কেট পাচ্ছেন। ফেসবুক এখন তার জন্য উজাড় করে মমতা ঢালছে।
খবরটার বাকি যেসব ডালপালা আছে, সেসবেও এক্সাইটমেন্ট কম না। নাঈম সাহেবের পিতৃ বৃত্তান্ত ভাল হিট করেছে। যদিও এখনো লাপাত্তা, তবে ধরা পড়লে নিঃসন্দেহে হিট করবে। ড্রাইভার আর বডিগার্ড সাহেবও মাটির নিচে। উনারা কতটা কিসসার জন্ম দেবে, বোঝা যাচ্ছে না। তবে দুই রুই কাতলাকে ধরার পরে, এই দুই পুটিকে কেন ধরছে না, তা খুব ভাল বোঝা যাচ্ছে না। আক্রান্তের ভাষ্য মতে, তাদের কাছে থাকা ভিডিও কি এর কারণ? সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে, কাহিনী কোনদিকে মোড় নেয়।
দুই অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রেফতার হওয়ায়, আপাতত ফেসবুক কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। ‘যাক একটা কাজ করে দেখালাম’ টাইপ একটা অনুভূতি সবার স্ট্যাটাসে। তবে সঙ্গে কিছুটা সাবধানতাও রয়েছে, ‘কাজ এখনো শেষ হয়নি। ‘এদেশের লিগ্যাল সিস্টেমের যা অবস্থা, ঢিল দিলেই আসামি টাকার জোরে পার পেয়ে যাবে’ এই টাইপ সাবধানবাণী কেউ কেউ দিচ্ছেন। তবে যারা আইন পেশার সাথে যুক্ত, তারা এখনো তেমন আশ্বাস বাণী দিচ্ছেন না। রিমান্ডে পাওয়া বক্তব্যে অনেকে বেশ উচ্ছ্বসিত হওয়ায় তারা স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে রিমান্ডের বক্তব্য কোনো কাজেরই না, কিংবা আইনি দৃষ্টিতে যে তার কোনো দামই নেই। মেডিকেল রিপোর্টেও যে তেমন কিছু পাওয়া যাবে না, তাও অনেকে জানান দিচ্ছেন। সো, আইনি প্রক্রিয়া কি ফলাফল এনে দেবে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট।
রেপ কেসগুলোতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারগুলোর জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে, তার একটি হচ্ছে ঘটনার রগরগে বর্ণনা। ভেবেছিলাম বাঙালির এই স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে কিংবা অন্তত এই কেসে এমনটা কেউ করবে না। বিধি বাম। জনৈক ব্লগার অ্যান্ড ফেসবুকার আক্রান্তের সাথে কথা বলে, সেদিনের ঘটনার ডিটেলস তার স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানান দিয়েছেন। বর্ণনা কত ইরোটিক হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে আপাতত তার সেই বর্ণনা হিট। হাজারে হাজারে শেয়ার। যদিও তিনি বোঝাতে চাইছেন, তার উদ্দেশ্য সঠিক চিত্র তুলে ধরা, তবে তার উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্নমতও রয়েছে।
ইনফ্যাক্ট, প্রতিটি হিট রেপের পরে, যেসব পাঠক রগরগে বর্ণনা পড়বার জন্য অপেক্ষা করে বসেই থাকে, ত্রাতার ছদ্মবেশে তাদেরকেই এই উপহার দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির পত্রিকা, যারা এসব বর্ণনা নিয়ে হাজির হয় তারা যেসব যুক্তি দেখায়, এক্ষেত্রে যুক্তিও অনেকটা একই, পাবলিককে আসল তথ্য দেওয়া। ব্যাপারটা যে হবে, আগেই আন্দাজ করেছিলাম, তবে কাজটা যে জনৈক প্রগতিশীল ব্লগার, করবেন, ভাবিনি। এনিওয়ে, অনেকে দেখলাম বর্ণনা পড়ে দুঃখে ‘আহা উহু’ করছেন, অ্যাজ ইফ ডিটেলসটা না জানলে মেয়ে দুটার প্রতি সঠিক সহানুভূতি জাগছিল না… ‘কি করুণ কাহিনী’। অনেকে প্রতিবাদ করেছেন, ‘কাজটা ভাল হয়নি।‘ তবে সংখ্যায় কম। ফেসবুকে এই এক সমস্যা, প্রগতিশীল প্রগতিশীল জোট। এনিওয়ে, পিপলস আর এঞ্জয়িং।
রেপের ঘটনার পরে কিছু ট্র্যাডিশনাল পন্থীরও উদ্ভব হয়। ‘মেয়ে দুটো কেন এত রাতে হোটেলে গিয়েছিল’। এই গ্রুপের ওপর সাধারণত সবাই খড়গহস্ত হয়ে আক্রমণ করেন। ইতোমধ্যে এই প্রশ্নের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেছে। বেশ কয়েকজন দেখলাম, এমন প্রশ্নকারীদের আনফ্রেন্ড কিংবা ব্লক করছেন। কেউ কেউ জানাচ্ছেন ‘এমন প্রশ্ন এখন না। এতে ধর্ষকদের পরোক্ষে সাপোর্ট করা হয়’। ফলে ফেসবুকে দুটো গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে আর ফেসবুকের নিয়ম অনুসারে একে অপরকে কটাক্ষ করাও শুরু করে দিয়েছে।
ঘটনার সাথে ভারতীয় ‘পিঙ্ক’ ছবির সাদৃশ্য থাকায় অনেক আঁতেল দেখলাম ‘পিঙ্ক’ সিনেমার ডায়ালগ ‘নো মিনস নো’র বিপুল ব্যবহার শুরু করেছেন। কমবেশি সবাই দেখলাম, একবারের জন্য হলেও ডায়ালগটা নিজের স্ট্যাটাসে দিয়েছে। এরা ধরেই নিয়েছেন, ধর্ষক বেশ নীতিবান, ‘নো’ শব্দটি শোনার সাথে সাথে তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন এবং তিনি আর রেপ করবেন না। ইজ ইট দ্যাট সিম্পল?
প্রতিটি রেপের পরে যেসব নিয়মিত প্যাচাল শুরু হয়, পোশাক তার মধ্যে অন্যতম। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। পোশাক একজন পুরুষকে প্রোভক করে কি না, করলে কি করণীয়, এমন আলোচনা কেউ কেউ শুরু করতে চাইছেন। এর বিরোধী পক্ষের বক্তব্য, পুরুষকে সংযত হতে শিখতে হবে। কেউ ধর্মীয় বিধানকে টানছেন, কেউ আইনের শাসনকে টানছেন। বেশ বিদঘুটে অবস্থা। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই ধরনের বিতর্ক প্রায় প্রতিটি রেপের পরেই নিয়ম করে করা হয়, কোনোবারই কোনো ফলাফল আসে না এবং প্রতিবারই দেখা যায় কিছুদিন পরে কেউই আর এই টপিকে কোনো আলাপ করে না। নতুন কোনো এক্সাইটিং ব্রেকিং নিউজ আসলেই, টপিক চেঞ্জ। এক্ষেত্রেও দ্যাট মৌসুমি ডিবেট ইজ গোইং অন…
বনানী টাইপ ঘটনা হঠাৎ করে বিবেক জাগালেও ব্যাপারটা ইউনিভার্সাল না। বরং এসব ঘটনার কারণে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা পরে, সাইড ইফেক্ট আর কি। বনানী ঝড়ে সেই পিতা কন্যার আত্মহত্যা, ঠাকুরগাঁওয়ের শিশু ধর্ষণসহ অনেক ঘটনাই লাইমলাইট পেল না। সম্প্রতি গোদাগাড়ীর জঙ্গি দমন কিংবা কন্যাসহ মায়ের আত্মাহুতিও মাঠে মারা গেল। আই থিঙ্ক আগামী কিছুদিন, খুব বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে, বনানীই বাজার মাতাবে, স্পেশালি দিলদার সাহেব ইজ অসাম। যেভাবে ডায়ালগের জন্ম দিচ্ছেন, তাকে শিরোনাম থেকে সরানো অলমোস্ট ইম্পসিবল।
সো, সারাংশ কি দাঁড়াল? আমরা সামাজিক অনাচার নিয়ে চিন্তিত? ক্ষমতার দাপটে আইনকে নিজের হাতে নেওয়াকে ঘৃণা করছি? আমার মনে হয় তেমন কিছুই না। ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ’ টাইপ একটা ব্যাপার হয়েছে আসলে। এমন গ্ল্যামারাস রেপ অনেকদিন পরে পাওয়া গেছে। উঁচুমহলের ঘটনা, ধনীর দুলাল, ফোরস্টার হোটেল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, পুলিশের টালবাহানা আর সঙ্গে রেপ তো আছেই। সব মিলিয়ে বেশ মশলাদার খবর।
আচ্ছা, আমি কি খুব নেগেটিভ কথাবার্তা বলছি? ওকে। মেনে নিলাম, বলছি। তনুর ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলেছিলাম, অ্যান্ড আই ওয়াজ রাইট। হয়তো এর পরের রেপগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটা বলব। কারণ? কারণ হচ্ছে, রেপের প্রতি আমাদের আটিচিউড এখনো পালটায়নি। পুলিশ থেকে শুরু করে নেতা, কেউই এই অপরাধটার ব্যাপারে সিরিয়াস না। এমন কোনো ‘নো টলারেন্স’ টাইপ দৃষ্টিভঙ্গি কারও ভেতরেই দেখা যাচ্ছে না। কারণ? এটাই আসল কথা। সব্বাই আমরা কেমন যেন ‘মানিয়ে চল’ অবস্থানে স্থির হয়ে আছি। ছিনতাই হলে, দোষ আপনারই, কেন বেরিয়েছিলেন রাতের বেলা, চুরি হলে, দোষ আপনার, কেন তালা দেননি। অর্থাৎ, বাস্তবতা মানুন, সমঝে চলুন।
আমার হতাশার কারণ এটাই। এখনো আমাদের মানসিকতা হচ্ছে চোর ডাকাত রেপিস্ট থাকবেই, আপনাকেই বুঝে শুনে চলতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন কি দেখতে পাচ্ছেন? অ্যাট লিস্ট কোনো সূচনা? তাহলে? কেন আশাবাদী হব? এবারেরটায় ফাইল হয়তো নড়েছে, কিন্তু পরেরটায়? পুলিশ ঠিকঠাক মতো কেস নেবে? ফরমান আলিরা সব লাইনে এসে গেছে? গ্যারান্টি দিচ্ছেন, ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি হবে না? তাহলে? হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন এই কেসে কিছু একটা তো হলো। সেটাই কি চাওয়া? এতেই কি সন্তুষ্ট থাকতে হবে? ভাবুন। বাই ফর নাও অ্যান্ড এঞ্জয় দ্য শো।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট