নিঃশব্দ যুদ্ধ সাইবার হামলা
মোহাম্মদ আবু নোমান
অপরাধ আর সন্ত্রাসের জন্য এখন আর মারণাস্ত্র বহনের প্রয়োজন নেই। অপরাধীরা আজ অস্ত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে নামি-দামি কম্পিউটার, কার্ড, স্মার্টফোন দিয়ে সাইবার অপরাধ করছে। যে দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০১ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ফিলিপাইনের ক্যাসিনোর জুয়ার আসরে চলে যাওয়া।
সম্প্রতি র্যানসমওয়্যার ভাইরাসের আক্রমণে কম্পিউটার লক হয়ে যাওয়াসহ মনিটরে একটি বার্তা ভেসে ওঠে। এতে কম্পিউটার চালানোর জন্য ৩০০ থেকে ৬০০ ডলার মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অর্থাৎ মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে সমস্ত ডেটা, এনক্রিপশন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নিমেষে। একেবারে যেন অপহরণের জন্য মুক্তিপণ চাওয়া! ‘র্যানসম’ ও ‘ম্যালওয়্যার’ মিলিয়ে এই হানার নাম দেওয়া হয়েছে ‘র্যানসমওয়্যার’। ‘ট্রোজান ভাইরাসের’ মতো এ ধরনের ম্যালওয়্যার এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে বহু দেশ নিজেদের সাইবার নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করছে। আক্রমণ না হলেও ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এ ধরনের আক্রমণ মনিটরিং বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ বলেন, জাতীয়ভাবে মনিটরিং করার তেমন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
সাইবার অপরাধীরা যেভাবে মুক্তিপণ চাচ্ছে তাতে আমাদের ওই বহুল কথিত কৌতুকের মতোই অবস্থা হবে নাকি? এক ভদ্রলোকে কাছে উড়ো চিঠি এলো, ৩ দিনের মধ্যে ২৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ হিসেবে না দেন, তাহলে আপনার বৌকে কিডন্যাপ করব। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ উত্তর প্রেরণ করেন, ‘এত টাকা দিতে আমার সম্পূর্ণই অনিচ্ছার সঙ্গে কিছুটা অক্ষমও। পরে পুনশ্চ যোগঃ আশা করি আপনারা আপনাদের কথা রাখবেন’।
ছিচকে চোরের মতো নিরিবিলি কাজ সারার মোক্ষম অস্ত্র সাইবার হামলা। যে হামলার কার্যকারিতা ব্যাপক। অথচ সাইবার যুদ্ধে ধ্বংস বা রক্তপাত নেই, সবচেয়ে বড় কথা নেই কোটি ডলার খরচের খড়গও। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আজ যেমন তাদের শক্তি ও সক্ষমতা দেখিয়ে থাকে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ছাড়াও সময়োপযোগী বিভিন্ন সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী নিয়ে। সময় পাল্টেছে, আজ তেমনি প্রতিটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ এমনকি পারমাণবিক গবেষণাগারও সাইবার হামলার হুমকির মুখে। ২০১০ সালে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা ব্যহত করতে সাইবার হামলায় ‘স্টাক্সনেট’ নামে একটি ভাইরাস কম্পিউটারে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এ গুপ্তচরবৃত্তি ধরা পড়ে অনেক পরে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে সাইবার অপরাধী দমনে নিরাপত্তাখাতে স্থায়ীভাবে যোগ হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা শাখা। কারণ সাইবার গুরুত্ব সামরিক গুরুত্বেও চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সাইবার ইস্যু আজ পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও বেশি আলোচিত। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে হিরোশিমা নাগাসাকির পারমাণবিক বিপর্যয়ের চেয়েও মারাত্মক ও ভয়াবহ কোনো বিপর্যয়।
যেকোনো ধরনের যুদ্ধ বা সন্ত্রাসী হামলা নয় বরং সাইবার হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সবচাইতে বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট হ্যাকিং বা ই-মেইল আইডির গোপন সব তথ্য জেনে নেওয়া, এ ধরনের সাইবার হামলায় একটি দেশের অর্থনীতিও ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য সাইবার হামলাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ‘কি পয়েন্ট ইনস্টলেশনের’ (কেপিআই) বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অবস্থা কেমন তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বেও সঙ্গে ভাবেত হবে। আমাদের রয়েছে দুটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনীর ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, সামরিক ও বেসামরিক বিমান ও নৌ চলাচল ব্যবস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের নিজস্ব নেটওয়ার্ক, বন্দর ব্যবস্থাপনাসহ রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র। এ বছর আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট উদ্বোধন করা হবে। তখন এই সব কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? আর এদের নিরাপত্তাই বা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? এখন থেকেই সম্ভাব্য দুর্ঘটনাগুলো চিহ্নিত করতে হবে আপতকালীন সময়ে করণীয়গুলো কী কী? কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কার কি দায়িত্ব, সেগুলো এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্রাউডস্ট্রাইকের গবেষক অ্যাডাম মায়েরস জানিয়েছেন, একবার এ ভাইরাস কোনো নেটওয়ার্কে কার্যকর হতে পারলে তা দ্রুত পুরো অবকাঠামোটিতেই ছড়িয়ে পড়ে। তখন এটিকে আর কেউ আটকাতে পারে না। এখনো আক্রান্ত দেশগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ না হলেও ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং বিডিনগ বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ সাবির। তিনি বলেন, এ তালিকায় বাংলাদেশ থাকার ঝুঁকি রয়েছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সাইবার হামলার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। খোদ ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘র্যানসমওয়্যার’ সফটওয়্যার ছড়িয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে কম্পিউটার। অনেক দেশের স্বাস্থ্য, টেলিকম বা যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত এ হামলার শিকার।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানান, পরিচিত ম্যালওয়্যার বা ক্ষতিকর এ সফটওয়্যার প্রোগ্রামটি কম্পিউটার কিংবা মুঠোফোনের মতো যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সেটির নিয়ন্ত্রণ চলে আসে হাতের মুঠোয়। তখন ব্যবহারকারীকে নিজের কম্পিউটারে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। অনেক সময় হার্ডডিস্কের অংশ বা ফাইলে পাসওয়ার্ড দিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। পরে তা থেকে মুক্তির জন্য অর্থ দাবি করে হ্যাকাররা। ইন্টারনেটের সর্বব্যাপী প্রভাব যেভাবে বিশ্বজুড়ে আমূল বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনমান, কাজের ধারাÑ তেমনি রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি তৈরি হচ্ছে এই ইন্টারনেটের মাধ্যমেই।
মানুষ যত বেশি সভ্যতার আলোক পাচ্ছে, তত বেশি করে আনন্দেও সামগ্রী খুঁজে ফিরছে। এর সঙ্গে আধুনিক যুগের প্রাণ প্রাচুর্য ও বিভিন্ন পন্থা আবিষ্কারের সঙ্গে তত বেশি করে জীবনকে উপভোগ করছে। কেননা সময় ও যুগোপযোগী কৃষ্টি কালচারের ভোগ-উপভোগ অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ধারণ করছে জীবন চলার পথে প্রতিটি মানুষ। সাইবার আক্রমণ এক সময় কল্পকাহিনী মরে করা হতো। এখন আর কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, ইতোমধ্যে এ রকম হামলার শিকার হয়েছে বহু দেশ।
তথ্য চুরির মতো অপরাধ এখন আর কোনো নতুন খবর নয়। রতœ পাথর বা দামি কষ্টি পাথরের মূর্তি না, তারা চুরি করছে তথ্য। যেখানেই যুদ্ধে জড়িয়েছে, সেখানেই কম্পিউটারগুলোর ব্যবচ্ছেদ করে হাতিয়ে নিয়েছে নানা তথ্য। ২০০৩ সালে ইরাকে হামলার সময় ব্যাপকভাবে কম্পিউটারগুলোর মেমোরি হাতিয়ে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের এক সাইবার হামলায় হ্যাকাররা ৫০ কোটি গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করেছিল বলে জানিয়েছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইয়াহু।
এক রাষ্ট্র তার নিজস্ব শক্তি সামর্থ্য দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের গোপন তথ্য চুরি করছে। সেটা করেই ক্ষান্ত থাকছে না; সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আক্রমণ করছে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার সময় পাকিস্তানি ভূ-খ-ে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানায় অপারেশন পরিচালনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সিল সেনাদের কয়েকটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছিল। আর সেটার ব্যবহার করা হয়েছিল পাকিস্তানের আকাশসীমার অনেক ভেতরে-অ্যাবোটাবাদে। সেটার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগাম কোনো অনুমতি পাকিস্তানের কাছ থেকে নেয়নি। কেননা তাতে অভিযানের গোপনীয়তা ক্ষুণœ হতে পারত এবং বিন লাদেন পালিয়ে যেতে পারতেন। আবার একটি স্বাধীন দেশের ভেতরে অভিযান পরিচালনা করা ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। তাতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। সেই সম্ভাবনা দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে অকেজো করে দিতে হয়েছিল। আর সেটা করা হয়েছিল বিভিন্ন বিমান ঘাঁটির কম্পিউটারচালিত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় হ্যাকিং করেই। ফলে এই সব বিমান ঘাঁটিগুলোর রাডার সিস্টেম বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পাকিস্তানের মাটিতে নিরাপদে বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল। নিরাপত্তাবিষয়ক ওয়েবসাইটগুলোয় প্রকাশিত যে ম্যাপ দেখাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় দুর্ভেদ্য সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
ধনঁহড়সধহ৭২@ুসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান