বনানীর ধর্ষণ এবং নষ্ট সমাজের ইতিবৃত্ত!
রাজধানী ঢাকার তথাকথিত ধনাঢ্যদের এলাকা বলে পরিচিত বনানীতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বহুল আলোচিত ধর্ষণ মামলা দেশের প্রগতিশীল চিন্তাবিদদেরকে অস্থির করে তুলেছে। সারা বাংলাদেশে সংঘটিত নিত্যকার বহু নির্মম ও বিয়োগান্ত ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিদ্রোহ-বিপ্লব না করে কেন সবাই বনানীর বিতর্কিত এবং চটুল কাহিনী নিয়ে মেতে ওঠেছেন তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন।
গুজবের পেছনে হুজুগে চলার আদি ও অকৃত্রিম তকমা এ জাতির ললাটের বহুদিনের পুরনো ঐতিহ্য বলে সর্বজন স্বীকৃত। মানুষের বিপদে সাহায্য না করে বরং বিপদ দেখে দাঁত বের করে হাসার ঐতিহ্যও কম নয়। বিপদগ্রস্ত মানুষকে নতুনভাবে আক্রমণ করে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে লীলাখেলার বহু উদাহরণ বাঙালি সমাজকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে আছে। কোনো ঘটনার গভীরে প্রবেশ না করে কেবলমাত্র বাহ্যিক বিচারে রায় প্রদান করে আমাদের সমাজ প্রতিনিয়ত কত মানুষের যে সর্বনাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে তার হিসেব কে কখন রেখেছে?
বনানীর রেইনট্রি নামক হোটেলে গভীর রাতের একটি অসামাজিক অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছায় যোগদান করে দুই তরুণী ঘটনার প্রায় দেড়মাস পরে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। তাদের এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো পূর্বাপর ঘটনার সত্যতা, বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই পুরো দেশ একযোগে ধর্ষণকারী বলে অভিযুক্ত তরুণত্রয় এবং তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ওপর হামলে পড়েছে।
অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের কথাবার্তা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে ডার্টি মানির, ডার্টি মানুষজনের, ডার্টি মনমানসিকতা নষ্টামীর প্রান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। জনৈক ধর্ষণকারী বলে অভিযুক্ত তরুণের পিতা তার ছেলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে যা বলেছেন তা আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগেও ঘটত না। অন্যদিকে ধর্ষিতার জবানবন্দি, কথাবার্তার পাকামী এবং মনমানসিকতা আমাদেরকে যারপরনাই বিক্ষুব্ধ এবং হতাশ করেছে। এ কথা নিশ্চিত যে, তারা স্বেচ্ছায় এবং লোভের বশবর্তী হয়ে সে রাতে হোটেলে গিয়েছিল। বখে যাওয়া তরুণদের নষ্টামী, মাদক গ্রহণ এবং উশৃঙ্খলতা সম্পর্কে তারা বেশ ভালোভাবেই জানতেন। ফলে কথিত ধর্ষিতাদের ব্যাপারে আবেগপ্রবণ হওয়ার পূর্বে তাদেরকে নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
ধর্ষণ ঘটনার জের ধরে আপন জুয়েলার্সে দেশের শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হঠাৎ তল্লাশি এবং কয়েকটি শো-রুম সিলগালা করে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে ফায়দা নিয়ে রাতারাতি নায়ক হওয়ার বাসনায় কিছু সরকারি কর্মকর্তার এহেন আচরণ সরকার ও রাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং হুজুগে স্বভাব প্রমাণ করে। তাদের উচিত ছিল বড় বড় সোনার দোকানগুলোতে একসঙ্গে অভিযান চালানো। অন্যদিকে সরকারের উচিত শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগকে কারণ দর্শানো যে, কেন তারা বিগত দিনে দেশের জুয়েলারি শিল্পের খোঁজ খবর নেয়নি?
একটি অবোধ শিশুকন্যার নির্মম ধর্ষণের বিচার না পেয়ে দরিদ্র পিতা এবং তার শিশুকন্যার রেললাইনে আত্মহননের ঘটনা জাতির বিবেককে বিক্ষুব্ধ না করে কেন অবৈধ অর্থের মালিক-শ্রমিক এবং বখাটে তরুণ-তরুণীদের নষ্টামীর খবর আমাদেরকে বেশি মাত্রায় উত্তেজিত এবং উৎসাহী করে তুলল তার মনোজাগতিক কারণ খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা কি উল্লেখিত দুর্ঘটনায় সত্যিই বিক্ষুব্ধ নাকি কোনো কারণে নিজেরা ডিপ্রেসড হয়ে এমনটা করছি? অথবা অবৈধ অর্থবিত্ত এবং নষ্ট মানুষদের নষ্টামী কি আমাদের নিজেদের অজান্তে আমাদের মনে প্রভাব ফেলে নাকি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা নিয়ে ভাবনার সময় চলে এসেছে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট