অন্যের বাতি নিয়ে এসেছিলেন তিনি
আজ ১৭ মে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের জন্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ আবেগ, আনন্দ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিন। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুবিহীন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় আলো হাতে আঁধারের কান্ডারী হয়ে এসেছিলেন জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। দিনটি ছিল রোববার। কালবৈশাখী ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়াও গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখো মানুষের মিছিল। সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহর-নগর-বন্দর থেকে অধিকারবঞ্চিত মুক্তিপাগল জনতা ছুটে এসেছিল রাজধানী ঢাকায়। সামরিক তন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী লাখো কণ্ঠের øোগানে প্রকম্পিত পুরো রাজধানী। একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত জনসমুদ্র। জনসমুদ্রের প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৮১ সালের ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ এমনি একটি দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর স্বামী-সন্তানসহ ছয় বছর বিদেশে কাটিয়ে ১৯৮১ সালের এই দিনে ঝড়-বৃষ্টিকবলিত প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বৈরী হাওয়ার মুখে তিনি এসেছিলেন বাঙালির জন্য, বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে। বিদেশে থাকাকালেই ১৯৮১ সালের ১৬Ñ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তার হাতে তুলে দেন দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যের সাফল্যগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পতাকা। লাখো মানুষের প্রাণঢালা উষ্ণ সম্ভাষণ এবং গোটা জাতির স্নেহাশীষ ও ভালবাসার ডালা মাথায় নিয়ে প্রিয় স্বদেশ ভূমিতে ফিরে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার আগমনে সেদিন গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বদলা নেয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল, আর অবিরাম মূষলধারে বারিবর্ষণে যেন ধুয়ে-মুছে যাচ্ছিল বাংলার পিতৃ হত্যার জমাট বাঁধা পাপ আর কলঙ্কের চিহ্ন। জননেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আজকের মতো সেদিনটি এমন নিষ্কলুষ ছিল না। শেখ হাসিনার চলার পথও ছিল না কুসুমাতীর্ণ। জননেত্রী শেখ হাসিনা দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে লন্ডনে রেখে এ দেশে গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে আসেন। ১৯৮১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের লাখো মানুষের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। শুধু দেশের বৃহত্তম দলই নয়, এই ৩৬ বছরে জনগণের আস্থা অর্জন করে প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটসংখ্যা বাড়িয়েছেন দ্বিগুণ-ত্রিগুণ হারে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন বলেই সব ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সামরিকতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশবাসী পেয়েছিলেন কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে ¯্রােতের বিপরীতে সেই যে উজানে নাও বাওয়া শুরু করেছিলেন জাতির জীবনে সাফল্যের পালক পরিয়েই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে কুড়িবারের বেশি। যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, তাদের সব হিসাব-নিকাশ যেন মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল। দেশের মাটিতে নেমেই অন্ধকার দুঃসময়ে আলোর প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে তিনি নামলেন গণতন্ত্রের সংগ্রামে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর স্নেহসান্নিধ্য পাইনি তারা তার যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার স্নেহসান্নিধ্যে ধন্য হলাম। আমরা তার স্নেহছায়ায় কাছে থেকে দেখলাম দুঃখী বাংলার মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও আস্থা এবং দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট। তার সাহসী সংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি তিনি কীভাবে একের পর এক প্রাণনাশের আঘাত, হামলা, নির্যাতনের মুখে অমিত সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্বই দিলেন না, আমাদের বুকের ভিতরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুনও জ্বালিয়ে দিলেন।
আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র রক্ষক। নিজে রাজনীতি করার পাশাপাশি তার দুই সন্তানকেও সুশিক্ষিত করে তুলেছেন। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় ইতিমধ্যেই সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন নেত্রী যিনি নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে কর্মীদের ভালোবাসেন নিজ সন্তানের মতোই। মায়ের স্নেহ-মমত্ববোধ থেকে সন্তানদের বঞ্চিত করে তা কর্মীদের নির্দ্বিধায় দেন। অসহায় বিপন্ন মানুষের কাছে ব্যাকুল চিত্তে তিনি ছুটে যান মানবিক হৃদয় নিয়ে, মায়ের ভূমিকায় পাশে দাঁড়ান। তার মতো স্নেহশীল মা, কর্মীবান্ধব সভানেত্রী, প্রাজ্ঞ দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেত্রী যেভাবে দেশ ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিরন্তর পথ চলছেন, দেশের স্বার্থে যেভাবে আপসহীন দৃঢ়তা দেখিয়ে এসেছেন তা ইতিহাসে তাকে অমরত্ব দেবে। বিশ্ববরেণ্য নেতারা শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘মেধা, যোগ্যতা, সততা আর লোভ, মোহের ঊর্ধ্বের পথচলা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবেন, আমাদের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবেন, ততদিন দেশ উন্নয়নের সিঁড়িপথেই হাঁটবে, ততদিন গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত হতেই থাকবে, ততদিন গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে। দেশ হবে তার স্বপ্নের দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।
লেখক: এনামুল হক শামীম-সাবেক জাকসু ভিপি, সাবেক সভাপতি- বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।