আশা, নিরাশার প্রশ্নগাঁথা
কাকন রেজা
আপন জুয়েলার্সের ‘জুয়েল’ পুত্র ও তার এক সহযোগী ‘চৌদ্দশিকে’ ঢুকেছেন। ড্রাইভার ও বডিগার্ডও ‘কট’। বাইরে আছেন আরেকজন ‘জুয়েল’। ধারাবাহিকতায় মনে হচ্ছে দেশে থাকলে তারও বাইরে থাকার উপায় নেই। তবে ‘চৌদ্দশিকে’ ঢোকার আগে তাদের ‘কটে’র ব্যাপারে অনেকের মতো আমিও সংশয়িত ছিলাম। কারণও আছে, বনানী থানার ওসি যখন উত্তরা ক্লাবের সদস্য হন, যেখানে সদস্য পদের মূল্যমান এক কোটি টাকা তখন সংশয়িত না হয়ে উপায় থাকে না। গণমাধ্যম যখন জানায়, ধরা পড়ার মুহূর্তে সেই ‘জুয়েল’রা পুলিশ কে দশ কোটি টাকা ‘অফার’ করে, এমন খবরেও সংশয়িত না হয়ে উপায় থাকে না। এছাড়া কোনো কোনো মাধ্যম ‘অপরাধ’ বাদ দিয়ে যখন ‘ভিক্টিম’দের ঠিকুজিকুষ্ঠি সংগ্রহে ব্যস্ত হয় তখন সংশয় নিজের অজান্তেই সংক্রমিত হয়। যখন অপরাধের ধরন থেকে বাপের টাকাপয়সা, প্রতিষ্ঠানই মুখ্য হয়ে ওঠে। যখন চোখের সামনে মাছভর্তি জলাশয় দেখে শিকারিদের জাল নিয়ে নেমে পড়ার দৃশ্য বন্ধ চোখে ভাসে, তখন সংশয়ের সংক্রমণ এমনিতেই ঘটে। সংশয়িত হওয়ার বা সংক্রমণের আরও অনেক কারণ বলা যায়, কিন্তু তাতে শুধু লেখার অবয়ব বাড়বে এবং সঙ্গে বিরক্তি।
তবে এসব সংশয়ের মধ্যে আশার কথাও রয়েছে। যখন শুনি দশ কোটি টাকা অফারের পরও ‘জুয়েল’ পুত্রের কানে পুলিশের থাপ্পড় পড়ে তখন আশান্বিত হতে হয়। যখন দেখি এদের রিমান্ডও হয় এবং সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদও হয় তখন আশান্বিত হতে হয়। যখন দেখি কৃষ্ণপদ রায়ের মতোন পুলিশ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে ব্রিফিং করেন তখন আশান্বিত হতেই হয়। সানি সানোয়ার নামে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আছেন যিনি ফেসবুকে বেশ পরিচিত। তার একটা লেখায় দেখলাম ‘সব পুলিশই পচে যায়নি’ এমন একটি বাক্য এবং এই বাক্যটিও আশান্বিত করে। আমিও জানি সব পুলিশই পচে যায়নি। ঢাকা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়কে আমি চিনতাম পেশার সুবাদে হয়তো কিছুটা ব্যক্তিগতভাবেও। যতটা দেখেছি প্রফেশনাল এবং নির্ভেজাল মানুষ তিনি। বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই, জানি না এখনো তিনি তেমনটাই কিনা। তবে ওনাদের মতোন পুলিশ অফিসার যখন কোনোকিছু নিয়ে ব্রিফিং দেন তখন সত্যিকার অর্থেই একটা কিছু হবার আশা দেখা দেয়।
আশা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। ক্যান্সারে আক্রান্ত মরণাপন্ন মানুষও বাঁচার আশা করেন। নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত বাঁচার আশা বেঁচে থাকে। আমরা আশা হারাতে চাই না। আমরা জানি সবকিছু পচে যায় না, সবাই পচে যায় না। সবখানেই কিছু কিছু ‘ফিনিক্স’ থাকে, না হলে ধ্বংসস্তূপে নতুন প্রাণের সঞ্চার হতো না।
প্রথম পর্ব গেল। এখন অন্য কথায় আসি। বাংলাদেশের কী পরিমাণ সোনা আমদানি হয় তার একটি হিসাব বোধহয় কোনো একটি দৈনিকে দেখেছিলাম। সে হিসাবে আমদানির পরিমাণ খুবই নগন্য। কিন্তু আমাদের সোনার দোকানগুলো দেখলে তা মনে হয় না। অবশ্য মনে না হওয়ার কোনো কারণ নেই যেহেতু আমাদের বিমানগুলো প্রায়ই সোনা প্রসব করে। এমনকি বিমানবন্দরের টয়লেটেও সোনা পাওয়া যায়। কেউ কেউ হয়তো সেখানে ‘সোনা’ই ত্যাগ করতে যান! আমাদের সোনার দোকানগুলো হয়তো সেই ‘ত্যাগে’র সোনা’তেই ঝলমল করে। হীরা তো আমদানিই হয় না, কিন্তু দোকানগুলোতে হীরার কমতি নেই। হয়তো দেশের কোথাও কোনো গোপন খনি আছে। না হলে ‘আপন জুয়েলার্সে’র ‘আপন’ পুত্র এমন ‘জুয়েল’ হবে কেন?
এতো গেল আমদানি এবং দোকানের কথা। এখন আসি শুল্ক গোয়েন্দাদের কথায়। গণমাধ্যম জানালো আপন জুয়েলার্সের একটি শাখা তারা সীলগালা করে দিয়েছেন। অন্যান্য শাখাগুলোতেও অভিযান চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো জুয়েলার্সের ‘জুয়েল’গণ এমন কা- না ঘটালে এবং সামাজিক পরে গণমাধ্যম উচ্চকিত না হলে কী শুল্ক গোয়েন্দাদের দৃষ্টির ‘পাত’ কী এদিকে হতো। হলে যে দেশে হীরা আমদানি হয় না সে দেশের দোকানগুলোতে এত হীরা এলো কোথা থেকে? যে দেশে সোনা আমদানির পরিমাণ নগন্য সে দেশে এতো ঝলমলে সোনার দোকান হলো কোথা থেকে? এক আপন জুয়েলার্সে অভিযান চললে অন্যগুলো কী করেছে? নাকি ধর্ষণকা-ে মিডিয়া কভারেজ পাবার জন্যই তাদের এমন হঠাৎ কর্ম?
এবার আসি ‘রেইনট্রিতে’। শব্দটির বাংলা ‘বৃষ্টি গাছ’ অর্থাৎ বৃষ্টিতে আশ্রয়। আশ্রয় মন্দ নয়; কী বলেন? দরদিয়া আশ্রয়ের ‘হোটেল রেইনট্রি’তে অভিযান চালিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। কিন্তু কোনো ‘দ্রব্য’ তারা পায়নি। তারপর অভিযান চালিয়েছে শুল্ক অধিদফতর তারা পেয়েছে দশ বোতল ‘দ্রব্য’ অর্থাৎ বিদেশি মদ। প্রশ্ন করি ঢাকার অন্য হোটেলগুলো কী দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। এদের কারও কারও হয়তো বারের লাইসেন্স রয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু ওই ‘দ্রব্য’ পাওয়া যায় না কোনো অভিজাত (?) হোটেল, রেস্তোরাঁয়? ঢাকায় লাইসেন্স ছাড়া পানশালা রয়েছে কতগুলো? তাহলে শুধু ‘রেইনট্রি’ কেন? এটাও কি মিডিয়া কভারেজজনিত সংক্রামক রোগ?
প্রশ্ন উঠেছে সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও। নিউজ ট্রিটমেন্ট নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ প্রশ্ন আলোড়িত হচ্ছে। একটি অনলাইন পোর্টাল খবরও করেছে এই নিয়ে। একজন পিতা যখন তার শিশুকন্যার ধর্ষণের বিচার না পেয়ে কন্যাসহ ট্রেনের নিচে জীবন দেয়, এক মা যখন শিশুকন্যাসহ একই কারণে ট্রেনের নিচে মাথা পাতে তখন তো এতো উচ্চকিত হতে দেখা যায় না সংবাদের অনেক মাধ্যমকে। কেন দেখা যায় না? সেই দরিদ্র পিতার মাছ ভর্তি কোনো জলাশয় নাই দেখে? মৎস্য শিকারিদের ভালো মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা নাই দেখে? না কি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা যাবে না দেখে? নিজে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এমন প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছেও।
ফুটনোট : বুদ্ধ বলেন, ‘কামনা-বাসনা হলো সব দুঃখের মূল।’ আপন জুয়েলার্সের মালিক হয়তো তা বোঝেননি। হয়তো তার বোধের বাইরে ছিল, ‘অবিমিশ্র সুখ বলতে কিছু নেই। মাঝেমধ্যে সুখ আসে তাও দুঃখমিশ্রিত। দুঃখের হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।’ কোনো মানুষেরই নেই। নিস্তার পেতে পেতেই মানুষকে গত হতে হয়, নির্বাপিত হতে হয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান