এক হাস্যকর আয়োজন, কাঁদানে সুমো!
অরুণ কুমার বিশ^াস
গেল হপ্তায় জাপানের রাজধানী টোকিওতে অনুষ্ঠিত হলো এক হাস্যকর প্রতিযোগিতা- কাঁদানে সুমো। প্রায় চারশ বছর ধরে জাপানে এই আয়োজন হয়ে আসছে। শুনে হাস্যকর মনে হলেও যাদেরকে এই কমপিটিশনে ঘুঁটি বানানো হয়, সেই বেচারা শিশুরা কিন্তু বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। এই খেলার মূল কথা হলো বেশকিছু নাদান শিশুকে ধরিয়ে দেওয়া হয় জাপানি সুমোদের হাতে, জাপানি ভাষায় যাকে বলে ‘গেনদাই বুদো’ বা সুমো কুস্তিগির। এসব বাচ্চার বয়স দুই থেকে সাড়ে তিন বছর। সুমো কুস্তিগিররা এসব শিশুদের শূন্যে তুলে নিয়ে দুই হাতে ততক্ষণ পর্যন্ত ঝাঁকাতেই থাকবে, যতক্ষণ না ওরা তারস্বরে কাঁদতে শুরু করবে।
সুমোরা কিন্তু মামুলি জাপানি নয়। দেশের মানুষ তাদের বিশেষ সমীহের চোখে দেখে। যারা সুমো কুস্তিগির হবে, জন্মের পর থেকেই বাবা-মায়েরা তাদের রাষ্ট্রের জিম্মায় ছেড়ে দেয়। রাষ্ট্র তাদের স্পেশাল প্রশিক্ষণ ও খাদ্যখানা নির্দিষ্ট করে দেয়। সুমোদের কাজই হলো এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে বছরজুড়ে নানা রকম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। চাইলেও সুমোরা আম-জাপানিদের মতো যেখানে সেখানে যেতে বা যা খুশি তাই খেতে পারে না। বস্তুত তারা কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজকীয় সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকে।
সুমো মানে এক রকম কুস্তি, যেখানে দুজন ‘রিকিশি’ বা কুস্তিগির একে অপরকে নক ডাউন বা উল্টে ফেলার চেষ্টা করে। কেমন আক্রমণাত্মক কিছু নয় তবে এই খেলায় হার-জিতের উপর অনেক কিছু নির্ভর তরে। স্বয়ং রাজা উপস্থিত থেকে সুমোদের কুস্তিখেলা উপভোগ করেন। যেসব পরিবারের সন্তান শেষঅব্দি সুমো হিসেবে নির্বাচিত হয়, সেই পরিবারও রাজার দরবারে বিশেষ সম্মান লাভ করে। সুমো রিকিশিরা মাথায় ঝুঁটি করে চুল বাঁধে এবং কুস্তির সময় শুধু এক টুকরো কাপড় কোমর জড়িয়ে কুস্তিতে নামে। এদের জীবনের ফিলোসফি হলো এই জীবন সংক্ষিপ্ত, তাই ইহলৌকিক জীবনে অহেতুক বাড়াবাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই। একরকম কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও গ-িবদ্ধ জীবন সুমো কুস্তিগিরদের। ধারণা করা হয়, প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে সুমো কুস্তিগিরদের ‘কামি’ বা শিনটো স্পিরিটের সাথে লড়াই করে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। যারা এই অশরীরীর সাথে যুদ্ধে এঁটে ওঠে, তারাই কেবল পরবর্তী প্রতিযোগিতায় যোগ্য মর্মে বিবেচিত হয়।
আসুন এবার সেই ‘কাঁদানে সুমো’ কমিপিটিশনের ব্যাপারে কিঞ্চিত আলোকপাত করা যাক। বিশে^র সকল দেশেই কিছু না কিছু কুসংস্কার বা অযৌক্তিক নিয়ম-প্রথার প্রচলন আছে। কিন্তু তাই বলে জাপানেও! যেখানে কিনা শিশুরা কখনো কাঁদে না, ওরা ফুল ভালবাসে। জাপান মানেই সভ্যতার প্রতীক। তাহলে এমন বর্বরোচিত প্রথা সেখানে কি করে এলো! আর ওটা নতুন কোনো প্রথা নয়, দীর্ঘ চারশত বছর ধরে চলে এসেছে এই কাঁদানে সুমো প্রতিযোগিতা।
এই প্রদর্শনী দেখতে ফিবছর লাখো লোক জড়ো হয় টোকিও ময়দানে। সেখানে কম করে হলেও শ’খানেক তুলতুলেকে শিশুকে তুলে দেওয়া হয় সুমো কুস্তিগিরের হাতে। শিশুদের নির্দয়ভাবে চটকানো হয়। পেটে সুড়সুড়ি পেয়ে শুরুতে শিশুরা হাসলেও একটু পরেই গগনবিদারি কান্না শুরু করে। কারণ হুমদো দেখতে পালোয়ান কুস্তিগিরের ঝাঁকুনি সহ্য করা শিশুদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর শিশু যতক্ষণ না কাঁদবে, ততক্ষণ এই অমানুষিক কর্মকা- চলতেই থাকবে। অনেকটা যেন ভূত বা জিনের আছর তাড়ানোর নাম করে আমাদের তথাকথিত মূর্খ ওঝাদের ঝাড়–পেটা করার মতোন।
প্রশ্ন হলো এসব শিশুর বাবা-মায়েরা ‘কাঁদানে সুমো’ প্রথা মেনে নেন কেন! সন্তানের প্রতি তাদের কি এতটুকু মায়াদয়া নেই! আছে, কিন্তু তাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে কুসংস্কারের কালো কাপড়ে। মায়েরা বিশ^াস করেন, সুমো কুস্তিগিরদের হাতে শিশু কাঁদলে তাদের মঙ্গল হয়। শিশুরা ছোটবেলা থেকেই কষ্টসহিষ্ণু হতে শিখবে। যাতে বড় হয়ে কঠিন কাজ করতে গিয়েও তারা ভেঙে না পড়ে। খাসা যুক্তি! কবে পেরোবে সাগর, সেই জন্য এখনই জাহাজ বানিয়ে পানিতে ভাসাও!
আমি রীতি-পদ্ধতি বা মোটাদাগে প্রথার বিরোধী নই, তবে যে সকল প্রথা বা নিয়মের নিগড় আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে, মানুষের কার্যত কোনো কল্যাণে আসে না, সে সকল প্রথা ভেঙে ফেলার এখনই সময়। কী জাপানে বা বঙ্গদেশে, এহেন সংস্কারজাত জীবনপরিপন্থী ও অমঙ্গলজনক রীতি-পদ্ধতি পাল্টাতে হবে। নইলে শিশু শুধু জাপানে কাঁদবে না, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও অহিতকর নিয়ম-কানুন চলতেই থাকবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রথম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
সম্পাদনা: আশিক রহমান