উরফি অদ্ভুত এক গোপন বিবাহ প্রথা
রাহাত মিনহাজ
উরফি বিয়ে মিসরের শত বছরের পুরনো একটা প্রথা। এই বিয়েতে পাত্র-পাত্রীকে আইনগত কোনো দলিলে স্বাক্ষর করতে হয় না। হাতে লেখা চুক্তি বা অঙ্গীকার নামার মাধ্যমেই এ বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। তবে বেশি বিশ্বাসযোগ্য করতে মাত্র এক হাজার চারশ টাকার একটি অনানুষ্ঠানিক দলিলে স্বাক্ষর করেন পাত্র-পাত্রীরা। এ বিয়ের পর কেউই একত্রে বসবাস বা সংসার শুরু করে না। তারা পূর্বের মতোই তাদের পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন। তবে এ বিয়ে তাদের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বৈধতা দেয়। যৌন সম্পর্ক স্থাপনে শরিয়তের বাধা থাকে না বলে মনে করে মিসরীয়রা।
ধর্মীয় অনুশাসন ও প্রথা অনুসারে মিসরীয় সমাজে বিবাহ পূর্ববর্তী যেকোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ। বিবাহের পর অন্য কোনো নারীর সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনও হারাম। তবে প্রাপ্তবয়স্ক হলেই মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর মতো ইচ্ছামতো বিবাহ করার অধিকার মিসরীয় যুবকদের নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে গেলে একজন মিসরীয় যুবককে কয়েক কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়। বিয়ের এনগেজমেন্ট বা আকত্্ এর সময় মেয়েকে গহনা দিতে হয়। বিয়ের প্রস্তুতির জন্য মেয়ের পরিবারকে টাকাও দিতে হয়। এছাড়া ছেলেকে আসবাবপত্রে সজ্জিত করে বসবাসের জন্য একটা ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত করতে হয়। আনুষ্ঠানিক বিয়ের ক্ষেত্রে এত কাঠখড় পোড়ানোর পর একজন পুরুষকে বিয়ের যোগ্যতা অর্জন করে। এছাড়া থাকতে হয় মোটামুটি একটা মাসিক আয়ের নিশ্চয়তা। কিন্তু মিসরের আর্থসামাজিক অবস্থায় ২৫-৩০ বছর বয়স্ক একজন যুবকের পক্ষে বিয়ের জন্য ‘সাত-সমুদ্দুর তের নদী’ সমান এত শর্ত পূরণ করা সহজ নয়। আর তাই মিসরে পুরুষদের বিবাহের গড় বয়স আরব বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ৩৫ থেকে ৪০ বছর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়সের এ হার আরও অনেক বেশি। বিবাহের এসব কঠিন শর্তের জন্যেই দেশটি উরফি বিয়ের প্রচলন সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানী মাহাদি সাফতি। তিনি আরও বলেন মিসর পৃথিবীর অন্যতম রক্ষণশীল সমাজ। আর তাই বিবাহের পূর্বে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কোনো বৈধতা এখানে নেই। আর তাই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বাধা দূর করতেই মিসরীয় তরুণ-তরুণীরা এ বিয়ের প্রতি বেশি বেশি ঝুঁকছে বলে মনে করেন মাহাদি সাফতি।
বর্তমানে মিসরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে। মিসরের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন উরফি বিয়ে করেছে। আর এতে ছেলে-মেয়ে মিলে উরফি বিয়ে করেছেন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার লাখ। আগামী বছর মিসরে উরফি বিয়ের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। উরফি বিয়েতে নারীদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকলেও সনাতন বিয়ের শর্ত শিথিল করা ছাড়া এ বিয়ের হার কমানো সম্ভব নয়। স্কুল ও কলেজগুলোতে ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে পড়াশোনা করার ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ভালোবাসা সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু অত্যন্ত ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় তারা উরফিতে বাধ্য হয়। যার মাধ্যমে তাদের শারীরিক সম্পর্কে পর্দা দেওয়া হয়। সমাজবিজ্ঞানী কারিম মনে করেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উরফি বিয়েকে নিষিদ্ধও করেনি আবার পুরোপুরি সমর্থনও দেয়নি। ফলে এই সমস্যা দিনেদিনে বাড়ছে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বিভাগের অধ্যাপক ড. গামাল কুতুব মনে করেন, বেশিরভাগ উরফি বিয়ে গোপনে পরিবারের কোনো সদস্যের মতামত ছাড়াই হয়, আর তাই এ ধরনের বিয়ে পুরোপুরি অবৈধ।
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান