হে নব্য আঁতেল, সব রেপই সমান সেক্সি না
মহা কনফিউশানে আছি। কি নিয়ে লিখি। বনানী নিয়ে কত আর লেখা যায়? এখন তো রীতিমতো বিরক্ত লাগছে। সেদিন রাতে কি কি ঘটেছিল, প্রায় মুখস্থ হওয়ার দশা। অন্য টপিক যে চয়েস করব, তারও তো উপায় নাই। এই মুহূর্তে অন্য কোনো নিউজ পাবলিকে চেখেও দেখবে না। দেখছেন না, ট্রাম্পের বেকায়দা অবস্থা, ব্রিটেনের নির্বাচন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর রিকশা ভ্রমণ, কিচ্ছু পাবলিক খাচ্ছে না। ইভেন অন্য রেপগুলোও মাঠে মারা যাচ্ছে। বিশ্বাস না হয় পত্রিকা খুলেন। দেখেন, প্রথম পেজে বনানী হাজির। অনলাইনে ঢোকেন, ফেসবুকের নিউজফিডে পত্রিকার যেসব নিউজ আসছে, দেখেন। ব্লগ কিংবা সেলিব্রিটি ফেসবুকারদের স্ট্যাটাস পড়েন। সবখানে বিভিন্ন শিরোনাম নিয়ে হাজির হচ্ছে বনানী। কখনো নাঈম আবার কখনো সাদমান। নয়তো থাকছে সেদিনের ঘটনার বিবরণী কিংবা সেই ধর্ষিতার ভিডিও সাক্ষাৎকার। কখনো কখনো আবার হাজির হচ্ছেন শার্লক হোমসের বাঙালি ভার্সান, ‘কিভাবে এই ভিডিও অনলাইনে আসল? কে লিক করল?’ সঙ্গে থাকছে মৃদু বিবেকের দংশন, ‘এরা কি সাংবাদিক? ছবিটা ঠিকমতো ব্লারও তো করেনি।’
এ ধরনের কেসগুলোতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে ব্যাপারটা থাকে, তা হচ্ছে ‘কেচ্ছা’। আর কেচ্ছা যদি ওপর মহলের হয়, তবে তো কথাই নাই। যে কয়জন রিমান্ডে ঢুকেছেন, তাদের কাছ থেকে নিত্যনতুন তথ্য আসছে। দুটোই আসছে। বনানীর দিন কি করেছিল সেটাও যেমন আসছে তেমনি আসছে পুরনো কাসুন্দি। কবে, কার সাথে… সেসব বৃত্তান্ত। পাবলিকও গোগ্রাসে গিলছে। তবে পাবলিক মনে হয় সবচেয়ে বেশি অপেক্ষায় ছিল নাঈমের জন্য। যাকে বলে ‘মোস্ট আওএটেড ফিল্ম’, বাহুবালি-২ কেও হার মানায়। তো সেই প্রতীক্ষারও অবসান হয়েছে। নাও ওয়েটিং ফর ‘নিউ কেচ্ছা’।
নাঈম রিলেটেড একটা দুটো খবর আগেই পাওয়া গিয়েছিল। নাঈম সাহেবের ফেসবুক ঘেঁটেও অনেকে অনেক তথ্য হাজির করেছেন। এখনো সেটারই ফলোআপ চলছে। সঙ্গে বোনাস হিসেবে যোগ হচ্ছে নাঈমের সাথে বিভিন্ন সেলিব্রেটির সেলফি। বিভিন্ন স্পেকুলেশানে এখন বাজার জমজমাট। এসবের প্রথম ক্যাজুলাল্টি সম্ভবত নিশো। সম্ভবত বলছি, কারণ অনেকেই দেখলাম দ্বিমত পোষণ করেছেন। ইটিভি কর্তৃপক্ষও দেখলাম কারণ জানাননি। ইন আ নাট শেল, অন্য কারণ থাকলেও, পাবলিক ধরেই নিয়েছে, সেলফির কারণেই চাকরি গেছে। সেলফি আরও পাওয়া গেছে। এবার গুজবের বাজারের টপিক হচ্ছে, অমুকের এবার কি হবে?
ওদিকে ‘রাতে কেন গেল’ বিতর্ক এখনো চলছে, তবে গতি কমেছে। পুলিশের কিছু জয় জয়াকার হচ্ছে। শুরুতে এমন ছিল না। ফরমান আলির ছবি কিছুদিন ফেসবুকে ঘুরল, ‘এই সেই ওসি, যিনি কেন নিতে গড়িমসি করেছিলেন।’ এরপরে প্রথম কিছুদিন যখন সবকটাই লাপাত্তা ছিল, তখন রাগটা পুরো পুলিশ ফোর্সের ওপর গিয়ে পড়েছিল। শুরু হয়েছিল, ‘পুলিশ শালা টাকা খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে’। এরপরে রটনা আসল, ‘অপরাধীগুলো সিলেট বর্ডার ভারতে পালিয়ে গেছে’ তখন তো গালিগালাজ তুঙ্গে। এরপরে কাহিনীতে মোড় আসতে শুরু করল। পুলিশ যখন টপাটপ সবকটাকে ধরা শুরু করল, তখন দেখলাম পাবলিকের মুড দুম করে পাল্টে গেল। বেশ আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করল ফেসবুকে… ‘নাহ সব পুলিশ খারাপ না।’
যখন প্রথম দুজন ধরা পড়ল, তখন থেকে পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরতে শুরু করল, ‘পুলিশ চাইলেই পারে, কিন্তু আসলে চায় না’। এরপরের কিস্তিতে আসল বডিগার্ড আর ড্রাইভার। প্রতিটা ধরার পরেই বাজারে আসতে লাগল বিভিন্ন স্বীকারোক্তির গল্প। কিভাবে, কখন… আর সঙ্গে তো থাকছেই সেই ঘটনার ফিরিস্তি। শেষজনকে নিয়েও শুরু হয়েছিল স্পেকুলেশান। ‘এটাকে বোধহয় ধরতে পারল না। ইন্ডিয়া ভেগে গেছে’। তারপর তো ‘মি মোস্ট ওয়ান্টেড’ মশাই ধরা পড়লেন। এখন অবশ্য বাঙালির গোল্ডফিশ মেমোরি পুলিশের পুরনো কীর্তির কথা ভুলে গেছে। এখন শুরু হতে যাচ্ছে খেলার পরের ধাপ।
সবগুলো অপরাধীর ভেতর সবচেয়ে আলোচিত নাঈমের বর্ণাঢ্য জীবন আর পিতৃপরিচয় তাকে ইনস্ট্যান্ট হিট বানিয়ে দিয়েছে। জীবনের পরতে পরতে দুর্দান্ত সব কিসসা কাহিনী, কমবেশি সবারই মুখস্থ। প্রতিদিন সবাই বেশ উত্তেজনা নিয়ে সেসব গিলছে। সামনের বিসিএস পরীক্ষায় এ ব্যাপারে প্রশ্ন আসলে অবাক হব না। যাই হোক, এই মুহূর্তে বনানী সবাইকে বেশ উত্তেজিত করে ফেলেছে। নাঈমের পুরনো জীবনের পোস্টমর্টেম শুরু হতে যাচ্ছে। কার সহযোগিতায়, কিভাবে সে এতদূর উঠল, তার ফিরিস্তি কিছু কিছু চলে এসেছে, বাকিটা অন দ্য ওয়ে। আর সেখানেই অপেক্ষা করে আছে মজার খেলা। কত বড় বড় রুই কাতলার সাথে সখ্যতার খোঁজ পাওয়া যাবে আর কজনের কপাল পুড়বে। দ্য গেম ইজ নাও ইন নেক্সট লেভেল।
এক পত্রিকা দেখলাম রিপোর্ট করেছে, নাসিম সাহেব আর পলক সাহেব ‘ফাঁসি ফাঁসি’ করছে। লন্ডন থেকে নাকি গাফফার সাহেবকে তলব করা হয়েছে, ‘আমাদের বাঁচান’। এ রকম আরও অনেক কেচ্ছা সম্ভবত বাজারে আসবে। যেসব নায়িকা, গায়িকার সাথে সেলফি পাওয়া গেছে, তারাও যথারীতি সমস্যায় আছেন। কেউ মামলা করছেন, কেউ বিবৃতি দিচ্ছেন আর কেউ হয়তো অগোচরে কপাল চাপড়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে পত্রিকার জন্য সুখের দিন যাচ্ছে। অ্যান্ড অলসো ফর কলামিস্ট আর ফেসবুকার।
কিছু উঠতি ফেসবুকার আক্টিভিস্ট দেখলাম এর মাঝে অন্য রেপেরও প্রোপাগান্ডা ট্রাই করছে। বনানীর গার্মেন্টসকর্মীর রেপটাকে লাইম লাইটে আনবার চেষ্টা হলো, কাজে দিল না। আরও কিছু রেপ, শিরোনামও মনে নাই, সেসব নিয়েও অনেকে দেখলাম স্ট্যাটাস মারছে। ধারণা, রেপের সিজনে বোধহয় সব রেপই পাবলিক খাবে, কাজে দেয়নি। গাজীপুরের সেই রেপিস্টের ছবিও ভাইরাল করা হলো, এখনো ‘নো পাত্তা’। যিনি হাজার টাকায় সালিশের কথা বলেছেন, তার অবস্থা নিয়েও তেমন রিপোর্ট দেখছি না। আমি নিজেও একই কাজই করলাম। বেশি প্যাঁচাল পাড়লাম বনানী নিয়ে। অ্যান্ড অনেস্টলি স্পিকিং, এটা নিয়ে লিখতেই এনার্জি পাচ্ছি বেশি। বাকিগুলো সম্পর্কে ঠিক পড়েও দেখিনি।
এনিওয়ে, যেসব গবেট ভাবছে, বস্তির রেপ আর দরিদ্র হজরত আলির কন্যার রেপ নিয়ে এক্টিভিজম করবে, তারা আসলে এখনো বাঙালিকে চেনেনি। কোনটা নিউজ আর কোনটা নিউজ না, এটা এখনো বুঝতে শেখেনি। শিখবে, আর কিছুদিন যাক। যখন দেখবে এসব গরিব, ফকিরদের নিয়ে নিউজ করলে কেউ পড়ে না, তখন ঠিকই টপিক চয়েজ করতে শিখে যাবে। এই নব্য আঁতেলগুলো এখনো মার্কেট চেনে নাই, টের পায় নাই যে রেপ হ্যাজ ভ্যারাইটি। সেলিব্রিটি রেপ আর নরমাল রেপ… নট দ্য সেম থিং। দুটোর মার্কেট ভ্যালু আলাদা, দুটোর নিউজ ভ্যালু আলাদা।
সো? কি বুঝলেন? আমরা যে রেপ ভিক্টিমের জন্য চিৎকার করে কল্লা ফাটাচ্ছি, সেটা আসলে কি? ওটা দরদ? জনসচেতনতা? বিবেক? অ্যাক্টিভিজম? এক্সাইটমেন্ট? নাকি প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি? ভাবুন। আমি ততক্ষণে দেখি, নাঈমের সাথে আর কারও ঘনিষ্ট সেলফির খোঁজ পাওয়া যায় কিনা। ওকে? টিল দেন, টেক কেয়ার।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট