সৌদি আরবে ট্রাম্প-মেলানিয়াকে লালগালিচা সংবর্ধনা মধ্যপ্রাচ্য, সন্ত্রাসবাদ ও দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে আলোচনা
লিহান লিমা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর শনিবার প্রথমবারের মতো বিদেশ সফরে সৌদি আরব গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে রোববার ‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সম্মেলন’ এ যোগ দিবেন ট্রাম্প। সম্মেলনে ইসলামের শান্তিপূর্ণ দিক নিয়ে বক্তব্য দেবেন তিনি। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৪টি দেশের সরকারপ্রধান যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
শনিবার দুপুরে রিয়াদ বিমানবন্দরে ট্রাম্পকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। এই সফরে ট্রাম্পের সঙ্গী ছিলেন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প, ফার্স্ট ডটার ও ট্রাম্পের পরামর্শক ইভানকা ট্রাম্প, ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জ্যারেড কুশনারসহ ট্রাম্প প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিদেশিদের জন্য সৌদি সফরে পোশাকের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকলেও সফরে কালো জাম্পস্যুট পরেন মেলানিয়া। কোমরে ছিল সোনালি রঙ্গের বেল্ট। গলায় হালকা গহনা ও চুল ছেড়ে দেন তিনি। অন্যদিকে কালো রঙের ওপর সাদা কাজ করা গাউন পরেন ইভানকা।
ট্রাম্প পরিবারের সৌদি সফরের আগে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল-জুবাইর বলেছেন, ‘মেলানিয়া ট্রাম্পের পোশাকের বিষয়ে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। যেকোনো পোশাকেই তাকে সৌদি আরবে স্বাগত জানানো হবে।’
ট্রাম্পসহ যুক্তরাষ্ট্রের অতিথিদের সংবর্ধনা দেওয়ার পর বিমানবন্দরেই ট্রাম্প ও মেলানিয়ার সম্মানে ‘অ্যারাবিক কফি’ পানের আয়োজন করেন সৌদি বাদশাহ। আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, কফি পান শেষে কফির পেয়ালা নাড়িয়ে বাদশাহ সালমান বুঝিয়ে দেন পেয়ালায় আর কফি অবশিষ্ট নেই এবং এটাই আরবের ঐতিহ্য বলে তিনি ট্রাম্পকে জানান।
এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর খবরে বলা হয়, দেশের বিপর্যস্ত মুহূর্তে সৌদি সফরে গিয়েছেন ট্রাম্প। এফবিআই পরিচালক জেমস কোমিকে বরখাস্ত করার পর ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। চলতি সপ্তাহে রাশিয়া ইস্যুতে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে গিয়েছেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এই পুরো পরিস্থিতিকে পেছনে ফেলে সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে চাই।’
ট্রাম্পের এই সফর নিয়ে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ সফরটাকে ‘বলা যায় বাঁচা-মরার ব্যাপার’। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর সফল হলে চলমান সমালোচনা কিছুটা হলেও কাটাতে পারবেন ট্রাম্প। সিএনএন জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এই সফর নিয়ে চাপের মধ্যে আছেন। ট্রাম্পের সুনজরে আসার জন্য এই সফর সুন্দর ও সফল করাটাই এখন তাদের চেষ্টা। ইতোমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি, মানবাধিকারের বিষয়টিতে জোর দিতে ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুসলিম দেশ সফর করলেন ট্রাম্প। সিএনএনকে ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’র অ্যান্থনি কর্ডেসম্যান বলেন, বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টই প্রথম বিদেশ সফরে মেক্সিকো কিংবা কানাডা গেছেন। তাই ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর নিয়ে দেশ ও দেশের বাহিরে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ট্রাম্প কি দেশের স্বার্থ নাকি নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন এটি পরিষ্কার নয়।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচআর ম্যাকমাস্টার বলেছেন, ট্রাম্পের এই সফরের তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নতুন করে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়া। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রধান তিনটি ধর্মের মানুষের প্রতি একতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সৌদি ও মুসলিমবিরোধী অবস্থান নেন ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের পর ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২০১৬ সালে উইকনসিস রাজ্যের রেসাইন কাউন্টিতে এক নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প সৌদি আরবকে সুরক্ষা প্রদানের যে নীতি ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করছে তার বিরোধিতা করেন। এর আগে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। কারণ সৌদি আরবের তেলের ওপর ওয়াশিংটনের নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হারে কমছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফর বিষয়ক বিবিসি বাংলার একটি সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেনাজ মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের কখনই খারপ সম্পর্ক ছিল না। স্বার্থে আঘাত লাগলেই কেবল সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। ইসলামকে নিয়ে ট্রাম্পের বিভিন্ন মন্তব্যে সৌদি জনগণ ক্ষুব্ধ হলেও চাইলেই তা প্রকাশ করার সুযোগ পাবে না।
জার্মান রাষ্ট্রদূত ডিটার ডব্লিউ.হ্যালার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা জোরদারে ট্রাম্পের এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের সফরে সন্ত্রাস প্রতিরোধের বিষয়টি আলোচিত হওয়া অত্যন্ত খুশির খবর। ইউরোপ, আমেরিকা, মুসলিম, অমুসলিম দেগুলো একসাথে এগিয়ে আসলেই আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সফল হব।
সৌদি শূরা কাউন্সিলের সদস্য মুনা এ আলমুসাইত বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফর সৌদির নিরাপত্তা বিশেষ করে বৈশ্বিক নিরাপত্তা জোরদার করবে। এই সফরে ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি আলোচিত হবে। ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফরে মুসলিম দেশ নির্বাচন মুসলিম দেশের প্রতি আমেরিকার বিদ্বেষনীতি ভেঙে সমর্থনের ইঙ্গিত।
সৌদি সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রী আওয়াদ আল-আওয়াদ সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, বাদশাহ সালমান ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যকার বৈঠক দুটি দেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ককে আরো জোরদার করবে। এই সফরে দুটি দেশের মধ্যকার চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে উভয় দেশের অংশীদারিত্বের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রির চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তি হবে যা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়তা করবে।
সফরে সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদ ও দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে ট্রাম্পের। দুই দিনের সফরে ট্রাম্প সৌদি আরবের সঙ্গে একশ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির আশা করছেন। যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য নতুন করে প্রতিশ্রুতির প্রমাণ পায়। সফরে ট্রাম্পের জন্য রয়েছে বিনোদনের বিশেষ ব্যবস্থা।
এদিকে ট্রাম্পের সফরকে কেন্দ্র করে সৌদির রাস্তায় ট্রাম্প এবং সৌদি বাদশা সালমানের ছবি সম্বলিত অসংখ্য বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। রাস্তার দুইপাশে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পতাকা সারি সারি করে টাঙানো হয়েছে। আরব, ইসলামিক-ইউএস সম্মেলনের খবর সংগ্রহ করতে সারাবিশ্ব থেকে ৫ শতাধিক গণমাধ্যমকর্মী রিয়াদে অবস্থান করছেন।
২২ মে সৌদি সফর শেষে ইসরায়েল যাবেন ট্রাম্প। ফিলিস্তিনেও যেতে পারেন তিনি। নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছেন, প্রেসিডেন্ট হলে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যাবেন তিনি অর্থাৎ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিবে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল সফরের পর ২৪ মে এক দিনের সফরে রোম যাবেন ট্রাম্প। সেখানে ভ্যাটিকান প্রাসাদে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে এক জনসমাবেশে যোগ দেবেন তিনি। ২৫ মে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ট্রাম্প। এই সময় ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে তার। এরপর সামরিক জোট ন্যাটোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ট্রাম্প। সর্বশেষ জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিতে সিসিলি সফরে যাবেন ট্রাম্প। এর মধ্যদিয়ে শেষ হবে ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর। সূত্র: বিবিসি, আরব নিউজ, সিএনএন।
সম্পাদনা : আবু সাইদ।