নিম্ন আদালত সরকারের কব্জায়, উচ্চ আদালতও নিতে চায় : প্রধান বিচারপতি
এস এম নূর মোহাম্মদ : নিম্ন আদালত সরকারের কব্জায় বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানিতে গতকাল মঙ্গলবার আদালত এ মন্তব্য করেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বেঞ্চে পঞ্চম দিনের মতো এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা লওয়ার জুডিশিয়ারি (নিম্ন আদালত) কব্জা করে নিয়েছেন তো। এখন চাচ্ছেন সপ্রিম কোর্টকে নিয়ে নিতে। ১১৬-এর বিষয়ে আমাদের অভিমত কি ছিল? আপনিতো স্বাধীন বিচার বিভাগ চান। চান না? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অবশ্যই চাই। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, লওয়ার জুডিশিয়ারি যদি এক্সিকিউটিভের (নির্বাহী বিভাগের) হাতে থাকে তাহলে কী রকম হয়? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা অন্যকথা।
প্রধান বিচারপতি বলেন, অধস্তন আদালতের ৮০ ভাগ বিচারকের ক্ষেত্রে কার্যত সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনারা সরকার এগুলো চিন্তা করা উচিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বললে এটাও উঠবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা পলিটিক্যাল ইস্যু। অনেক ইস্যু থাকে। ভাস্কার্যও একটা ইস্যু হয়ে গেছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা পলিটিক্যাল ইস্যু না। আপনি এর সঙ্গে ওটা
টানবেন না। সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারপতি মোস্তফা কামালের চেতনার সঙ্গে আমাদের কিছু পার্থক্য ছিল। তিনি মাসদার হোসেনরের মামলায় রায় দিয়ে গেছেন। উনি বলেন নি অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি বলেন, পারসোনাল ওপিনিয়ন (ব্যক্তিগত মত)। ১১৬ তো ভিন্ন বিষয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, তাহলে আপনি জবাব দেন। একটা জেলায় ৫/৬ মাস ডিস্ট্রিক্ট জাজ (জেলা ও দায়রা জজ) না থাকলে বিচার বিভাগ কিভাবে চলে। বিচার বিভাগ কি রকম কার্যকর হচ্ছে? আপনার জবাব হলো এটা আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এখন উচ্চ আদালতের বিষয়টি পার্লামেন্টে নিয়ে গেলেন। থাকলো না কি বিচার বিভাগ?
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি আমেরিকার সংবিধানের প্রসঙ্গ আনেন। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সেখানে সংবিধান কতবার টাচ হয়েছে আপনি জানেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, টাচ হয়নি। সংযুক্ত হয়েছে। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা মূল সংবিধান সংশোধন করেছি। তা না করে সংযুক্ত করা যেতো। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাকে আমেরিকার সংবিধান জানতে হবে। আমরা ইঙ্গিত দিচ্ছি। উই দ্যা পিপল মানে কি? এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপের প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, সেখানে কংগ্রেসের একজন কাউন্সিলরের মনোনয়নও পার্টি দেয় না। (সেখানে তৃণমুলের সমর্থন লাভ করতে হয়)। উই দ্যা পিপল বলতে ওটাই।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ওই দেশের সংবিধান তারা তৈরি করেছে। আমাদের দেশের সংবিধান আমরা তৈরি করেছি। বিচার বিভাগ বলতে পারে না সংবিধান এই ব্যবস্থা ঠিক না। সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি যে দেশের সংবিধান আনবেন আমি রিপ্লাই দেব। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ২০১০ সালের সংবিধান সংশোধন বিষয়ে শুনানি উপস্থাপন শুরু করলে প্রধান বিচারপতি বলেন, আসল জায়গায় আসেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটি কনডন করেছিলেন। কমিটি আগেই হয়ে গিয়েছিল। সেখানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বিষয় ছিল। প্রধান বিচারপতি বলেন, যেটা ইস্যু না সেটা আপনি বলছেন কেন? ষোড়শ সংশোধনীর বিল নিয়ে আসেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ২০০৮ সালে যা ছিল, হুবহু তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে কিছু কিছু মন্তব্য হার্স (রুঢ়) হয়ে গেছে। এগুলো বাদ দেবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে এত কথা বললেন। এখানে তো কিছুই নেই। বিলটি কোথায়? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পেপারবুকে আছে। বিলে বলা হয়েছে, ৯৬ অনুচ্ছেরে অধিকতর সংশোধন সমিচিন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানেতো প্রস্তাবনা দেখা যাচ্ছে না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এরইমধ্যে সংবিধান ছাপা হয়ে গেছে। সামরিক আইন দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিধান আনা হলো।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ১১২ পড়েন। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। একটা গণতান্ত্রিক-সভ্য দেশের জন্য এবং কল্যাণকর রাষ্ট্র করতে চাইলে ১১১ ও ১১২ এর শর্তগুলো থাকা দরকার। এ পর্যায়ে বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, আপনি কি বললেন? আপনি বললেন, রায় দেবেন আইনের বিধান দেখে। এটা কি বললেন? আমরা কি তা মাথায় না রেখেই রায় দিবো? তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সব কিছু বিবেচনা করেই রায় দেবো। মানবাধিকার, সংবিধান, আইনের শাসন এসব কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। আমরা প্রত্যেকটা বাক্য, সেমিকোলন আলোচনা করে রায় দেই।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা সামরিক আইনের কথা বলছেন। এখনও ১৯৮২ সালের মার্শাল পিরিয়ডের আইন রয়ে গেছে। এখনো রেখে দিয়েছেন। আমরা এত বলার পরও। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা চেঞ্জ করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা বিচার বিভাগ চিন্তাভাবনা করি, রাষ্ট্রের যাতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। আমরা সব সময় অন্যায় আইনগুলে কে সহ্য করে যাচ্ছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ১৯৭২ এর মূল চেতনায় ফিরে যেতে সংবিধানের সংশোধনী আনা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু সেখানে মিস হওয়ায় দেশের স্বার্থে ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, সেখানে খুবই দুঃখজনক একটি অধ্যায় আছে। উচ্চ শিক্ষিত নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বাধ্য হলেন বিদায় নিতে। সামান্যতম নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিলেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও বিল পড়া শুরু করেন। বলেন, জনগণ ক্ষমতার মালিক। ৭ অনুচ্ছেদের চেতনা পুনর্বহালের জন্যই ৯৬ সংশোধন করা হয়েছে। এরপর আদালত বিরতিতে যান।
বিরতির পর আবারও শুনানি শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। হাইকোর্টের রায়ের সংসদ সদস্যদের নিয়ে আপত্তিকর বিষয়টি উপস্থাপন করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপত্তিকর মন্তব্য থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। মন্ত্রী সাহেবরা অনেক কথা বলেন। যা আমরা হজম করছি। করতে পারি। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যা বলি তা বিচার বিভাগের জন্যই বলি। আপনারা মন্ত্রীর কথা হজম করতে পারবেন তো। আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচারকদের বেতন বেড়েছে। এটা হলেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যায়? মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের বেড়েছে একবছর আগে। আমাদের একবছর পর।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি আপনার সঙ্গে আছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনিতো রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি বিচার বিভাগের সঙ্গেই থাকবো। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনমন্ত্রীর যে বিতর্ক, তা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা তৈরি হয়। এটা ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল।
প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন ওইসময় থেকে আর্থ সামজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ এর চিন্তা চেতনা থেকে ২০১৭ সালেল চিন্তা চেতনা। পিছনে থাকবেন? সামনের দিকে তাকাতে হবে।
সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানও পরিবর্তন হবে। এটা ব্যালান্স করতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা সামরিক আইন জারির মাধ্যমে হয়েছে। সেই সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে দিতেই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ওই সময়েতো অনেক কিছু হয়েছে। যা এখন আপনারা সংরক্ষণ করছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ভাল কিছু থাকতে পারে। ডাকাতেরও কিছু ভাল গুন থাকতে পারে। তাই বলে ডাকাতকেতো আর ভাল বলা যাবে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা কেন আপনাদের সংসদ সদস্যদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। ৭০ অনুচ্ছেদ কেন? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন এটা ঠিক না। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটাই ঠিক। ৭২এর সংবিধানে কেন আইন করেন নি? তিনি বলেন, আপনাদের প্রধান বিচারপতি স্ট্রং। পত্রিকায় বেড়িয়েছে এজন্য দেড় বছর যাবত বিচারপতি নিয়োগ হচ্ছে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই। এসময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, এ যুক্তি ঠিক নয়। যারা এসেছেন তারা অপরিচিত আইনজীবী। তারা এ বারেরই সদস্য। বিচার বিভাগে মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটা করতে পারেন।
প্রধান বিচাপরতি বলেন, তারা এই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তারা সচেতন নাগরিক। তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে। আপনি বলছেন, তাদের এখতিয়ার নেই। তাহলে কি আমি নিজে রিট করবো? এসময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
শুনানির শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি সংসদ সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকার কথা বলেছেন। এই বক্তব্য সত্য না হলে তাকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো উচিত।
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি কি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই। আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন।
এসময় অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পিছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন? সরকার কি মনে করছে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা আমার অভিমত। প্রধান বিচারপতি বলেন, কি বলছেন? ওহ্ আমরা ওঠে যাচ্ছি। এরপর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অপরাপর বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। তখন ঘড়িতে সময় বেলা সোয়া একটা।