ভাস্কর্য সরানো ও হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সরকারের সঙ্গে বাম দলের দূরত্ব বাড়ছে
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক, তাদের দাবি মেনে নেওয়া, তাদের কথায় সুপ্রিম কোর্ট ভাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য সরানো, ভাস্কর্য সরানোর সময়ে প্রতিবাদ মিছিল ও প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মামলা করেছে। এই সব বিষয় নিয়ে বামগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বাড়ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বামদলগুলো চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। সেটি সরানো হবে না। কিন্তু সেটি সরানোর জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। হেফাজতকে আশ্বাস দিয়েছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের এই বিষয়ে কথা বলার কথা নয়। এরপরও বলেছে। ভাস্কর্যটি কেন সরানো উচিত এবং ওই ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচনাও করেছে। এরপরও তারা চেয়েছে সেটি থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি সরানো হয়েছে। এতে তারা ক্ষুব্ধ। বাম দলের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তারা মনে করে সরকার হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে এই ধরণের উদ্যোগ নিবে এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাস্কর্যটি সরানোর কারণে বামদলগুলোর মধ্যে অসেন্তোষ তৈরি হলে তা কিছুটা প্রশমিত হয় যখন ভাস্কর্যট এ্যানেক্স ভবনের সামনে পুন:স্থাপন করা হয়েছে। হেফাজত বলেছে সব ভাস্কর্য অপসারণ করতে হবে। আবার এ্যানেক্স ভবনের সামনে স্থাপনের বিষয়টি তারা ইতিবাচকও ভাবে নেয়নি।
সব মিলিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ককে ভালভাবে নিচ্ছে না বামদলগুলো। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করে রাজনীতি করলে সেটা আতœঘাতী হবে। আশা করি, আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে কোনোরূপ সমঝোতার রাজনীতি করবে না। হেফাজতের তেঁতুল হুজুররা সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির জিকির তোলার চেষ্টা করছে, তাদের সঙ্গে উঠা বসা করা গণতন্ত্রের জন্য হবে আত্মঘাতী। বামদলের অনেকেই মনে জাসদের সমাবেশে বামনেতারা মনে করছেন, ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ভাস্কর্য স্থাপন করা মুর্তি পুজা নয়, ভাস্কর্য হচ্ছে শিল্প মাধ্যম। হেফাজতে ইসলামের তেঁতুল হুজুররা সকল ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
মূর্তিটি অপসারণ করায় হেফাজতসহ ইসলামি দলগুলো শুকরিয়া আদায় করে সরকারকে ধন্যবাদ জানায়। ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতে এবং শুক্রবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ করে বামপন্থী কয়েকটি সংগঠন। এ সময় পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষও হয়। একই দাবিতে তারা আজ আবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ করে।
শুক্রবার বাম ছাত্র নেতারা টিএসসি থেকে মিছিলসহকারে এসে সুপ্রিম কোর্টের সামনে মাজার গেট এলাকায় বিক্ষোভ করে। পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীসহ চারজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে বলে তারা অভিযোগ করেন। তাদের মুক্তির দাবিতে শাহবাগ থানার সামনেও বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা।
ঘটনার পর সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এবং বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এক যৌথ বিবৃতি বলেছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির তথাকথিত আন্দোলনের হুমকিতে ভীত হয়ে সরকার হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য অপসারণ করে। যা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নতি স্বীকারেরই নিদর্শন। তারা বলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য সমর্থনের আশায় বর্তমান সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপসের যে পথে গেছে তা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনছে। তারা সরকারের সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে নতি স্বীকারের যে রাজনীতি তাকে রুখে দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান দলের পক্ষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীকী ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রাতের অন্ধকারে কাজটি করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগসহ ধর্মান্ধ, ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ফিকিরবাজ সংগঠন ও সংস্থার দাবি ও চাপে শাসক দল ভোটের সমীকরণে প্রতারণামূলক কৌশলে এ কাজ করিয়েছে। পায়ের তলা থেকে সরে যাওয়া মাটি ভরাট করতে যেকোনো আবর্জনার ওপর দাঁড়াতেই আজ আর শাসকদের বাধছে না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফেরি করে এবং ২০ ভাগ থেকে ৯ ভাগ জনগোষ্ঠীতে নেমে আসা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্ভর করে, সর্বোচ্চ দরে ভোট কেনা-বেচার পসরা সাজিয়েও যখন ভোটের বাক্সের এক কোণা ভর্তি করা যাবে না নিশ্চিত হয়েছেন, তখনই তারা মৌলবাদী আর মুসলিম পার্থক্য রেখা ঘুচিয়ে বড় ভোট ব্যাংক হাসিলে ধর্মান্ধ শক্তির একটি বড় অংশকে মাঠে নামানোর পথ ধরেছে।
ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেছেন, মধ্য রাতে অতি গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে ফেলার ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধকামী জনগণের হৃদয় ভেঙে দেয়ার নামান্তর। বাংলা বর্ণমালা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আত্মপরিচয়ের বহুমাত্রিক সংগ্রামে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের এক রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রাম দেশ দুনিয়া কাঁপিয়েছিল। এ কথা মুক্তিযুদ্ধের অনুসারীরা অস্বীকার করবেন কোন মুখে? সাম্প্রদায়িকতাবাদী হেফাজতের কথিত মূর্তি যা বিশ্বজুডে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য তা অমর্যাদার সাথে অপসারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয় ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রতি নতি স্বীকার।
সুপ্রিম কোর্ট এর একটি সূত্র জানায়, ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়টি করা হয়েছে পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে।
এদিকে ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশ নেয়া নেতা-কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছেন ও মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি বাম নেতারা।