গণতন্ত্র একটি সরকার-ব্যবস্থা, গণতন্ত্র একটি মূল্যবোধ
গণতন্ত্র কেবল একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্র একটি মুল্যবোধের নাম, গণতন্ত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি জীবন-ব্যবস্থা Ñ কমপ্লিট কোড অব লাইফ; যে মূল্যবোধের মূল কথা টলারেন্স, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যের মতকে সম্মান দেওয়া; দেশে সেটা কতটুকু আছে? প্রতিদিন আমরা দেখছি গালাগালি আর দোষারোপের রাজনীতি; কুরুচি, চরিত্রহননকর আর অশ্লীল বাক্যবান। অথচ দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’ Ñ এর চেয়ে ভালো করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা, আমার মনে হয়, আর কেউ বলতে পারেননি; তো সেই ভলতেরিয়ান ফিলসফি থেকে আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি কত দূরে? দেশ স্বাধীনের পর অল্প কিছুদিন পরই আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এরপর ১৯৯১ সালে নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন হয়। এই দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একটি অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। সেটা হলো, সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় নিজের অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অবিশ্বাস। এই কারণে বিএনপি ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছিল। এরপর আওয়ামী লীগ তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর আবার বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসলে এই ভুলটা করতে চায়নি। তারাও চেয়েছিল ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে। পাঠক আপনাদের অনেকের মনে আছে হয়তো, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর এই আওয়ামী লীগই বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেঈমানি করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মনে কি বেঈমানি করা? এরপর আবার দেখুন, বিএনপি কিন্তু একই কাজ করল। ১/১১ মতো একটি সরকার আসার প্রেক্ষপট তৈরি হলো। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ এলো ক্ষমতায় কিন্তু বিএনপি আর সংসদে গেল না; পরের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ মহামান্য আদালতের সহায়তায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করল। হলো ইতিহাসের নজিরবিহীন তামাশার নির্বাচন Ñ ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারি; ছিল সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি, এবার তৈরি হলো নির্বাচন বর্জনের কালচার Ñ বিএনপি নির্বাচনে গেল না। ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্ব ভেবেছিল খুব দ্রুত আবার নির্বাচন দেওয়া হবে, সরকারের তরফেও তাই বলা হয়েছিল। কিন্তু না, ক্ষমতার স্বাদ কে ছাড়ে Ñ জোড়াতালি সংসদ দিয়েই আওয়ামী লীগ ৫ বছর পার করতে চলেছে। তার মানে বর্তমান দুই বৃহৎ রাজনৈকিত দল সবসময় একই পথে হেঁটেছে। কেউ কাউকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিতে চায়নি। চেয়েছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে; এবং পরাজয়কে মেনে নেওয়ার যে সাংস্কৃতিক যোগ্যতা সেটা প্রধান দুটি দলের কেউ-ই অর্জন করতে পারেনি, সংসদ বা নির্বাচন বর্জনের কারণ কিন্তু তাই। অথচ একটি গণতান্তিক দেশে কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চর্চার ক্ষেত্রে এটা হওয়া কথা না। কারণ গণতন্ত্র শুধু গণতন্ত্র নয় এটার মূলরূপ প্রকাশিত হয় কেবল অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই ভাবনা ভাবতে না পারে যে, সরকার চালানোর জন্যই বিরোধী দল প্রয়োজন, তাহলে সেখানে ‘গণতন্ত্রের অ্যান্টিবায়োটিক’ প্রয়োগ করে ‘গণতন্ত্রবিরোধী ব্যাকটেরিয়াকে’ ধ্বংস করা যাবে না।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৎড়নধবঃ.ভবৎফড়ঁং@মসধরষ.পড়স