রোজামুখে দাঁত মাজার বিধান
মুফতি হিদায়াতুল্লাহ আদনান
রমজান মাসে স্বল্প সময় নিয়ে সাহরি খায় অনেকেই। এক দিকে খাওয়া শেষ হয় অপর দিকে সময়ও শেষ হয়। দাঁত মাজার আর সময় থাকে না। বা, রমযানে ফজর নামাজ পড়ে লম্বা ঘুম দেওয়ার জীবনযাপনপদ্ধতিতে আমরা অভ্যস্ত। এক্ষেত্রেও ঘুম থেকে জাগার পর প্রয়োজন পড়ে দাঁত মাজার। সারা দিন রোজা রাখার পর দিনশেষে দাঁতে প্লাক জমে প্রচুর। তাই অনেকেরই প্রশ্ন, রোজামুখে কি দাঁত মাজা যায়? বা ব্রাশ করা যায়? হাদিসে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে এসেছে, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের সুঘ্রাণের চেয়েও প্রিয়। (মুসনাদে আহমদ : ১৩/৪৯/৭৬০৭) সাধারণভাবে এই হাদিসে মনে হতে পারে, রোজামুখে দিনের বেলা আর দাঁত মাজা যাবে না, যেহেতু মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে প্রিয়। বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক।
দাঁত পরিষ্কার রাখা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্নত (যা তিনি পছন্দ করতেন, দৈনন্দিন জীবনে প্রাকটিস করতেন ও যে বিষয়ে উম্মত অনাবশ্যকভাবে পালনের ব্যাপারে আদিষ্ট।) সুনানুন নাসায়ির এক হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে দাঁত মাজতেন।
(১/৩) মুহাক্কিক ইবনুল হুমামের বরাতে হাদিসের ভাষ্যগ্রন্থ মিরকাতে আছে : পাঁচ অবস্থায় দাঁত পরিষ্কার করা (মিসওয়াক করা) মুস্তাহাব :- ১. দাঁত হলুদ হয়ে গেলে, ২. মুখে দুর্গন্ধ হলে, ৩. ঘুম থেকে ওঠার পর, ৪. নামাজের আগে, ৫. অজুর পূর্বে। তিরমিজি শরিফের হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : আমার উম্মতের পক্ষে পালন করা যদি কষ্ট সাপেক্ষ মনে না হত তাহলে প্রতি নামাজের আগে দাঁত মাজার (মিসওয়াক করার) আদেশ দিতাম। (১/১২) অর্থাৎ ওয়াজিব ও অবশ্যপালনীয় হিসেবে উম্মতকে তখন সে আদেশ মানতে হত। ব্যাখ্যাকারী ইমাম নববী রহ. বলেন : এ হাদিস অনুযায়ী প্রতি নামাজের আগে (এবং অন্য বর্ণনা অনুযায়ী অজুর আগে) মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজা সুন্নত। আর রোজা রেখে আমরা তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। বহুবার অজু করি দিনের বেলা। তাহলে দাঁত মাজার সুন্নতটি ছাড়ব কেন?
ইসলামি ফিকহের কিতাবাদি ঘেটে দেখা যায় যে, বিধানগত মৌলিক দিক বিবেচনায় আমরা দুই জিনিসের মাধ্যমে দাঁত মেজে থাকি। ১. শুধু মিসওয়াক তথা গাছের ডাল দিয়ে, ২. মিসওয়াক ছাড়া অন্য যে কোন কিছু দিয়ে, যেমন- টুথপেস্ট, টুথপাউডার, নিমের মাজন ইত্যাদি।
আমরা দ্বিতীয় প্রকারের বিধান আগে আলোচনা করি। মিসওয়াক ব্যতীত দাঁত মাজার অন্য যেসব উপকরণ আছে, যেমন- টুথপেস্ট, টুথপাউডার, নিমের মাজন ইত্যাদি, এসবের মাধ্যমে রোজামুখে দাঁত মাজলে রোজা মাকরুহ হবে। (দেখুন : আলমগিরি ও শামি) মাজার সময় যদি এগুলোর সামান্যও গলায় চলে যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং কাজা করতে হবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।
মিসওয়াকের বিধান একটু ব্যতিক্রম। গাছের ডালজাতীয় কিছু দিয়ে দাঁত মাজা রোজামুখেও অনুমোদিত। এবং যেসব ক্ষেত্রে রমজানের বাইরে মিসওয়াক করা সুন্নত সেসব ক্ষেত্রে রমজানে রোজা রেখেও মিসওয়াক করা সুন্নত। তাই রোজা রেখেছি বলে মিসওয়াক করা যাবে নাÑ কথাটি সঠিক নয়।
মিসওয়াক যদি গাছের কাঁচা ডালেরও হয় তবুও রোজার কোন ক্ষতি হবে না। মিসওয়াকের ছোবড়া যদি সামান্য পরিমাণ গলায় চলে যায়, যা একটি ছোলা বুটের চাইতে পরিমাণে কম, তাহলেও রোজা ভাঙ্গবে না।
মিসওয়াক করতে গিয়ে যদি দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত বের হয় তাহলে তা থুথু দিয়ে ফেলে দেবে। রক্ত বের হওয়ার কারণে রোজার কোন ক্ষতি হবে না। যদি রক্ত গলায় চলে যায় আর তা মুখের থুথুর ভাগ থেকে কম হয় তাহলে রোজা ভাঙ্গবে না। তবে থুথুর ভাগের সমান বা বেশি হলে তা গলায় চলে গেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (দেখুন : আলমগিরি ও শামি)
রোজামুখে দাঁত মাজার সংক্ষিপ্ত বিধান এই। সুতরাং আমরা রোজা রেখেও দাঁত পরিষ্কার রাখার সুন্নত পালন করব। এক আমল করে সত্তর আমলের সওয়াব লাভের সুযোগ ছাড়ব না।
বাকি আছে রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে প্রিয় হবার বিষয়টি। এখানে আসলে উদ্দেশ্য হল, খিদের কারণে পেটের ভেতর থেকে উঠে এসে মুখ দিয়ে বের হওয়া গন্ধ। এখানে দাঁতে জমে থাকা পঁচা খাদ্যকণার দুর্গন্ধ উদ্দেশ্য নয়। তাই আসুন, রমজানে অন্যান্য আমলের মত মিসওয়াক করার সুন্নতের আমল করি।