সাহরি ও ইফতারের ফজিলত
মাহফুজ আল মাদানী
সাহরি গ্রহণের মাধ্যমে রোজা শুরু হয়। ‘শেষ রাতের খাবার, সাধারণত সুবহে সাদিকের পূর্বে রোজার নিয়্যতে পানাহার করাকে সাহরি বলে’। আর দিন শেষে ইফতারের মাধ্যমে রোজার সমাপিÍ ঘটে। ‘দিনের শেষে সূর্যাস্থের সাথে সাথে পানাহার করাকে ইফতার বলে’। চিরাচরিত নিয়ম হিসেবে সকলেই যার যার সাধ্যমত সাহরি ও ইফতার গ্রহণ করে থাকে। এই সাহরি ও ইফতারের মাঝে রয়েছে আনন্দ আর ইবাদাতের পরম সুখ। সাহরি আর ইফতারের রয়েছে আলাদা মর্যাদা ও ফজিলত।
যা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে স্বীকৃত হয়ে আসছে। সাহরির মধ্যে বরকত বা প্রাচুর্যতা রয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, (বোখারী ও মুসলীম)। আমাদের ও আহলে কিতাবদের মধ্যে রোজার ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। আমরা রোজার উদ্দ্যেশ্যে সাহরি গ্রহণ করি, আর আহলে কিতাবরা সাহরি খেত না। হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘হজরত আমর ইবনুল আ’স (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া’ (মুসলীম)। এই সাহরি গ্রহণের জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গী সাথীদের আহ্বান করতেন। হাদীস শরীফের ভাষ্যমতে, ‘হজরত ইবরাদ্ব ইবনে সারিয়া (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রমজানের সাহরি খেতে ডাকলেন এবং বললেন, বরকতময় খাবারের দিকে আস’ (আবু দাউদ ও নাসায়ী)। এ বরকতময় সাহরিকে কোনভাবেই বর্জন করা উচিৎ নয়। কোন কিছু না থাকলে খেজুরের মাধ্যমেও সাহরিকে সেরে নেয়া উচিৎ। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেজুর দ্বারা সাহরি করে নিতেন। ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুমিনদের জন্য খেজুর কতইনা উত্তম সাহরি’ (আবু দাউদ)।
রোজা রেখে দিন শেষে ইফতারের পালা। ইফতার রোজাদারের জন্য আনন্দময় মুহূর্ত। হাদীসের ভাষায়, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি (পরকালে) তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ লাভের সময়’ (বোখারী ও মুসলীম)। ইফতারের মধ্যে কল্যাণ ও বরকত রয়েছে। ইফতারের সময় দেরি করতে নেই। আমাদের সমাজে ইফতারের সময় অনেকে ইচ্ছা করে দেরি করে থাকেন। যা কখনো কাম্য নয়। আর হাদীসেরও বিরোধী। হাদীস শরীফে ইফতারের সময় হয়ে গেলে বিলম্ব না করে ইফতার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে, যতদিন তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করবে’ (বোখারী ও মুসলীম)। সময় হওয়ার সাথে সাথে যারা ইফতার করেন তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার প্রিয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
খেজুর দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত। আর তাতে কল্যাণ রয়েছে। সর্বোত্তম হলো তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করা। তাজা খেজুর পাওয়া না গেলে শুকনো খেজুর দ্বারা করলে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ ইফতার করতেন। হাদীসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মাগরীবের) নামাজের পূর্বেই কয়েকটি তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না মিলত তবে কয়েকটি শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুরও না মিলত তবে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা (ইফতার করতেন)’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)। অন্য হাদীসে খেজুর দ্বারা ইফতার করাকে কল্যাণকর বলা হয়েছে। ‘হজরত সালমান ইবনে সামির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তাতে বরকত রয়েছে। আর যদি খেজুর না পাওয়া যায় তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে।
কেননা, তা পবিত্রকারী’ -(তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী)। নিজে ইফতার করার পাশাপাশি অন্যকে ইফতার করানোতে অনেক পূণ্য বা সাওয়াব রয়েছে। তাই আমাদের সাধ্যমত অন্যকে ইফতার করানোতে এগিয়ে আসা উচিৎ। ‘হজরত যায়েদ ইবনে খালেদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে অথবা কোন যোদ্ধাকে জিহাদের সামগ্রী দ্বারা সজ্জিত করে দেবে তার জন্যও তার অনুরূপ সাওয়াব রয়েছে’ (বায়হাকী ও শারহুস সুন্নাহ্)। ইফতারের শুরুতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করে নিতেন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। তার দেয়া নিয়ামতের প্রশংসা করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘হজরত মু’আয ইবনে যুহরাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন এ দোআ পাঠ করতেন “আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওআ’লা রিজক্বিকা আফত্বারতু” (হে আল্লাহ! আমি আপনারই জন্য রোজা রেখেছি এবং আপনারই দেয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি)’ (ইমাম আবু দাউদ মুরসাল হিসেবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)। ইফতার শেষেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোআ করে নিতেন।
‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, “যাহাবা জ্জামায়ু ওয়াব্তাল্লাতি উরুক্বু ওয়া ছাবাতাল আজরু ইনশাআল্লাহ” (পিপাসা দূর হলো, শিরা উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান তবে প্রতিদান স্থির হলো) (আবু দাউদ)। এভাবেই সাহরি ও ইফতারের ফজিলত বা মর্যাদা আলোচিত হয়েছে। আমাদের উচিৎ সাহরী ও ইফতারের কল্যাণের প্রতি খেয়াল রেখে সময়মত সাহরি ও ইফতার করা।