স ও শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পকেট নিংড়ানোর বাজেট
রুহিন হোসেন প্রিন্স
এবারের জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে জনগণের মনে একটা বড় প্রশ্ন ছিল যে, ‘এটা করের বোঝা বাড়ানোর বাজেট হবে, নাকি স্বস্তির বাজেট হবে?’ কিন্তু বাজেট ঘোষণার পরে দেখতে পেলাম, বাজেটের আকার বড়, তবে সাধারণ মানুষকে কোনো স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং বলা যায়, এবারের বাজেট হলো সৎ আয়ের এবং শ্রমজীবী মানুষের পকেট নিংড়ানোর বাজেট। বিএনপি আমলের চালু কার পুঁজিবাদী নয়া উদারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের ভিত্তিতে এই বাজেট প্রণীত হয়েছে। এখানে উপেক্ষা করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক দর্শনসহ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে। যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের সংবিধানের অর্থনৈতিক দর্শনকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। গতবারের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বড় এবারে বাজেটের ঘাটতি এক লাখ বারো হাজার কোটি টাকা। এই বাজেটের টাকা আয় করার জন্য রাজস্ব বাজেটের চৌত্রিশ শতাংশ বেশি আয় করতে হবে রাজস্ব খাত থেকে। এছাড়া ঢালাওভাবে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে পনেরো শতাংশ। অর্থাৎ এইসব টাকা আয়ের জন্য সাধারণ মানুষের পকেট গণহারে কাটতে হবে। অন্যদিকে আমরা দেখলাম যে, শতশত কোটি টাকার মালিক তাদের কাছে কর বাড়ানোর কথা নেই বাজেটে, নেই পাচার হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত আনার কথা, নেই হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের কথা। বরং আবারও কালো টাকা সাদা করার একটা অনৈতিক সুযোগ বহাল রেখে লুটপাটকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। শ্বেত হস্তির মতো বিশাল সিভিল ও মিলিটারি আমলা প্রশাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিলাস দ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতি সিস্টেম লসের নামে লুটপাট বহাল রেখে এই বাজেট প্রণীত হয়েছে। যা অব্যাহত থাকলে সমাজে বৈষম্য আরও বাড়বে এবং এটা অনিবার্যভাবে দেশে অস্থিরতাকে প্রসারিত করবে। আমরা জানি দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, অন্য বেকারত্বও তো আছেই। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো দিক নির্দেশনা দেখতে পেলাম না এই বাজেটে। তুলনামূলকভাবে কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে। তাই মেহনতি কৃষক, শ্রমিক ও সৎ আয়ের মানুষদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই এই বাজেটে।
বাজেট ঘোষণার আগেই গ্যাসের দাম বেড়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী গ্যাসের দাম আবারও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এবং মনে রাখা দরকার এ ধরনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হলে শুধুমাত্র প্রতি মাসেই বেশি টাকা খরচ হবে এমনটি নয়, বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়বে এটা মনে রাখতে হবে। বিদ্যুতের দাম সরাসরি না বাড়ালেও ভ্যাটের কারণে আরও দশ শতাংশ বেড়ে যাবে। যা জনগণের উপরে আরও বাড়তি চাপের সৃষ্টি করবে। ব্যাংকে টাকা রেখেও নিরাপদ থাকবে না সাধারণ মানুষ। তাদেরকেও অতিরিক্ত করের বোঝা বইতে হবে। এই বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার জন্য কিছু খাতে বরাদ্দ বাড়লেও বাজেটে সাধারণ মানুষকে বেশি ভ্যাট ও করের বোঝা বইতে হবে। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নিয়মিত আয়, কর্মসংস্থান এবং নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিবে না এবারের এই বাজেট। অতীতেও আমরা দেখেছি বাজেটে অনেক কিছু বরাদ্দ করা হয় কিন্তু সেই বরাদ্দ খরচ করা হয় না। এটি আমাদের বাজেটের একটা বড় দুর্বলতা। আরেকটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে শেষ মাসে এসে এই বর্ষা-বাদলের সময় দেখা যায় বাজেটের প্রায় বিশ শতাংশের বেশি খরচ হয়। এই খরচ মানে দুর্নীতি এবং অপচয়ে ভরা থাকে এটা সকলেই জানে। গতবারে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে যে নারী উদ্যোক্তা খাতে বাজেট ছিল একশ কোটি টাকা কিন্তু খরচ করা হয়েছিল মাত্র চৌত্রিশ কোটি টাকা। শিশু উন্নয়ন খাতে রাখা হয়েছিল চল্লিশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে আঠারো কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র কৃষক এবং পোল্ট্রি ফার্মের বাজেট দেওয়া হয়েছিল একশ কোটি টাকা অথচ এক টাকাও খরচ করা হয়নি। মাঠ উন্নয়ন এবং সংস্কারে সত্তর কোটি টাকা দিলেও মাত্র পঁচাশি লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। সুতরাং এবারের যে বাজেট আমরা দেখলাম এই বাজেট আমার কাছে মনে হয় এটা একটা অনির্ভরযোগ্য এবং অবাস্তবায়নযোগ্য। বাজেটে আমরা দেখলাম স্থানীয় সরকার পরিষদের জন্য উল্লেখযোগ্য বড় বরাদ্দ রাখা হয়নি। অথচ মেগা প্রজেক্টের নামে বড় বরাদ্দও থেকে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই সামগ্রিকতায় মনে হয় এই বাজেটের যে ঘাটতি বাজেট এই ঘাটতি পূরণ করা, তার পরে কর আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হয়েছে সেটা আদায় করা একটা কঠিন কাজ বলেই মনে হয়। সুতরাং এটি একটি অনির্ভরযোগ্য এবং অবাস্তবায়নযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয়।
পরিচিতি : সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি
মতামত গ্রহণ: সাগর গনি
সম্পাদনা : আশিক রহমান