প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকৃত্রিম বনাম নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের কৃত্রিম জনপ্রিয়তার পরিণতি
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণমাধ্যমে আবার আলোচনায় এসেছেন। তবে এবার যে কারণে তিনি এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন তা যদি শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কোথায় নামবে তার চাইতেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণœ হবে সেটিই ভাববার বিষয়। ড. ইউনূস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তখন দল মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিশ্বে ড. ইউনূসের মাধ্যমে আমাদের একটি নতুন পরিচয় তৈরি হয়, গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণের ধারণা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আলোচনায় স্থান করে নেয়। কিন্তু ১/১১ এর পর অধ্যাপক ইউনূস রাজনীতিতে আবির্ভূত হওয়ার যে চেষ্টা করেছিলেন সেটি ফানুসের মতো ফেটে যায়, ড. ইউনূসও অনেকটা ধরাশায়ী হয়ে পড়েন। ইউনূসকে যেভাবে এতোদিন মানুষ চিন্তা করেছিল, কিংবা পেতে চেয়েছিলÑ তিনি এর কোনোটিই বুঝতে পারেননি। তার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিদেশেই প্রথম প্রশ্ন ওঠে, পরে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাংকের শীর্ষপদে থাকা নিয়ে তিনি সরকারের সঙ্গে আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে তিনি মামলা-মোকদ্দমা করেও শেষ পর্যন্ত হেরে যান। যতটুকু জানা যায় সরকার তাকে অসম্মান করতে চাননি, কিন্তু তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষপদটি ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারেননি। কেন পারেননি সেটি রহস্যের বিষয়। একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষপদটি মোটেও বড় কিছু ছিল না। এই নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক মহলসহ অনেকেই দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েন, তারা ড. ইউনূসের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে ব্যাংক আইন এবং বিচারালয়ের রায়কেও ততটা গুরুত্ব দিতে চাননি। এরা ইউনূসের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে সরকারকে একহাত নিতে দ্বিধা করেননি। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কিছু মন্তব্য নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে গুণীদের সম্মান করা হচ্ছে নাÑ অনেকে তখন জোর গলায় এমন অভিযোগও উত্থাপন করেছেন। আবার কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে অধ্যাপক ইউনূসের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা তার সমালোচনা করছেন। এ ধরনের বহু সমালোচনা পত্র-পত্রিকার পাতা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আমরা দেখেছি ও শুনেছি।
বিষয়টি আরও সম্মুখে চলে আসে যখন পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ বিশ্বব্যাংক আকস্মিকভাবে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে প্রত্যাহার করে নেয়। যখন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এই ঋণ বন্ধ করার পেছনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করার অভিযোগ উত্থাপন করেন, মার্কিন প্রশাসনের দিক থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে বহাল রাখার জন্য চাপ সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেন তখন দেশে অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। বরং তারা এটিকে দেখেছেন শেখ হাসিনার স্বভাবসুলভ সমালোচনা, জেদাজেদি ও ব্যক্তিগত রেষারেষি হিসেবে। তারা কেউই এর গভীরে গিয়ে সত্য অনুসন্ধানের আগ্রহ প্রকাশ করেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নিয়ে এমন কিছু করবে সেটিও তাদের বিশ্বাসের ধারে-কাছেও স্থান পায়নি। শেখ হাসিনা বারবারই বিভিন্ন কারণে মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ অবস্থান থেকে নানা ধরনের চাপ, সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়ার কথা দেশবাসীকে জানিয়েছেন। সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসব আচরণকে বাংলাদেশের কোনো মহলই গুরুত্ব দিতে চায়নি। অথচ প্রকাশিত ইউনূস-হিলারির বিষয়ে মার্কিন সিনেটের বিচার বিভাগীয় কমিটি কর্তৃক গৃহীত তদন্তের উদ্যোগ সংক্রান্ত খবরাখবর পড়ে যে কারোরই এখন বোধোদয় হওয়ার কথা যে তখন ড. ইউনূস মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে যেসব ই-মেইল করেছিলেন তা এখন তদন্তাধীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে ইউনূসের কর্মকা- নিয়ে হিলারি ক্লিনটন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তাদের যেভাবে ব্যবহার করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সজীব ওয়াজেদ জয়কে যেভাবে নানা ধরনের চাপে রেখেছেন সেগুলোত বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোর প্রশাসনের অভ্যন্তরে কা-জ্ঞানহীন কর্মকর্তাদের নীতিভ্রষ্ট কর্মকা-ের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। সজীব ওয়াজেদ জয়কে নানাভাবে হয়রানির যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘটে তা আমরা কি কখনো ভাবতে পেরেছি? অথচ ঘটনাগুলো তখন তো ঘটেছিলÑ সাম্প্রতিক খবর থেকে সেটিই প্রমাণিত হচ্ছে। তখন সরকারপ্রধান হয়েও শেখ হাসিনা এসব চাপ হজম না করে প্রকাশ্যেই বলেছেন। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাজটিই তিনি করেছেন। আমাদের তো উচিত ছিল দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজের দেশের স্বার্থ ও মর্যাদার বিষয়টি সমুন্নত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো, তাকে বিশ্বাস করা। আমরা কি তা করেছি? আমরা তো বিশ্বাস করেছি নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে, তার জনপ্রিয়তাকে আমরা বিশ্বব্যাপী বড় করে দেখেছি। কিন্তু তিনি তিনি কি করেছেন? সেই উত্তর তো এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট থেকেই আমরা পেতে যাচ্ছি। প্রকৃত দেশপ্রেমিক কাউকে ভয় পায় না। পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদেরকে ধমক দেওয়ার চেষ্টা করে, ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে, কখনো কখনো হত্যাও করে। গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকব্যাপী এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ কজন রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে ক্ষমতাচ্যুত কিংবা হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু তাদেরই একজনÑ যিনি আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের লড়াইয়ে অনড় থাকার কারণে প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু শক্তিধর রাষ্ট্রের অন্যায় চাপ ও অপকর্মের কাছে মাথানত করেননি। তারই কন্যা শেখ হাসিনা মাথানত কোনো বিশ্বশক্তির অন্যায় চাপের কাছে মাথানত করবেন, বাংলাদেশকে অমর্যাদায় ঠেলে দেবেনÑ এমনটি যারা ভাবতে পারেন তারা কৃত্রিম আর অকৃত্রিমের ব্যবধান বুঝতে কতটা সক্ষম সেটিই মস্তবড় প্রশ্ন। তবে অধ্যাপক ইউনূস দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে একদিন যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা মার্কিন সিনেটের তদন্তাধীন অভিযোগ প্রমাণিত হলে কতটা ফানুসের মতো উড়ে যাবে সেটি বোধহয় আমরা নিকট ভবিষ্যতে দেখতে পাব।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়