ভ্যাটের জটিলতা নিরসন জরুরি
ইংরেজি সংক্ষিপ্ত ঠঅঞ শব্দটির পূর্ণরূপ হলো ঠধষঁব অফফবফ ঞধী. ভ্যাটকে বাংলায় সংক্ষেপে বলা হয় মূসক। যার পূর্ণরূপ মূল্য সংযোজন কর। ভ্যাট বা মূসক একটি পরোক্ষ কর। সর্বপ্রথম ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের অধীনস্থ রাষ্ট্র ফ্রান্সে ভ্যাট প্রবর্তিত হয়। অতঃপর অপরাপর রাষ্ট্র ফ্রান্সকে অনুসরণ করে। আমাদের দেশে ভ্যাটের প্রবর্তন ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানি দেশাভ্যন্তরে সেবা বা পরিসেবার উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আরোপযোগ্য। এই কর উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে কেবল পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। মূসক আরোপের মাধ্যমে আবগারী শুল্ক বিক্রয় কর ইত্যাদি প্রয়োজনীয়তা দূর হয়েছে।
আমাদের দেশে প্রথমে কিছু পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনের ওপর মূসক আরোপ করা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পণ্য এবং বেশকিছু সেবা, পরিসেবা, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় প্রভৃতি মূল্য সংযোজন করের আওতায় আনা হয়েছে। কালক্রমে মূসক সরকারের কর রাজস্ব এর অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনআরবি) মূল্য সংযোজন করের হার নির্ধারণ এবং এর আদায় ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্বে নিযুক্ত।
যেকোনো ভোক্তাপণ্যের উৎপাদন পরবর্তী এবং চূড়ান্ত বিক্রয়ের সময় ভ্যাট বা মূসক আরোপ করা হয়। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদক পণ্যটি বাজারজাত করার সময় এর ওপর ভ্যাট প্রদান করে থাকেন এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে পণ্যটি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন ভোক্তার নিকট বিক্রয় করা হয় তখন ভোক্তা ভ্যাট বা মূসক প্রদান করে থাকেন। একজন ভোক্তা যে পরিমাণ ভ্যাট প্রদান করে সেটি হলো পণ্য মূল্য থেকে পণ্যে ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য বিয়োজন পরবর্তী যে মূল্য দাঁড়ায় তার ওপর দেয় কর। পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে পণ্য প্রস্তুতে যে সকল উপকরণ ব্যবহৃত হয় সেগুলোর ওপর উৎপাদক ভ্যাট প্রদান করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি টেলিভিশন উৎপাদনের সময় এটিতে ব্যবহৃত যাবতীয় সরঞ্জামাদির ওপর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট প্রদান করে থাকে। পরবর্তীতে এ টেলিভিশনটি একজন বিক্রেতার দোকানে বিক্রয়ের জন্য উন্মুক্ত থাকাকালীন যখন ক্রেতা ক্রয় করেন তখন তাকে প্রযোজ্য ভ্যাট প্রদান করতে হয়। একজন প্রস্তুতকারক কর্তৃক উৎপাদিত পণ্যে আমদানিকৃত সরঞ্জামাদি বা দ্রব্য ব্যবহার করলে তিন পর্যায়ে ভ্যাট প্রদানের উপক্রম ঘটে। প্রথমত, আমদানিকারক বন্দর থেকে পণ্য খালাসের সময় দ্রব্যের আমদানিকৃত মূল্যের ওপর ভ্যাট প্রদান করে থাকেন। অতঃপর প্রস্তুতকারক পণ্যটি বাজারজাতকরণের সময় এর ওপর ভ্যাট প্রদান করে থাকেন এবং সর্বশেষ পণ্যটি যখন পাইকারি বা খুচরা পর্যায়ে ক্রেতার নিকট বিক্রয় করা হয় তখন ক্রেতা এটির ওপর ভ্যাট প্রদান করে থাকেন। উন্নত বিশ্বের যে সকল দেশে ভ্যাট চালু রয়েছে সে সকল দেশে একটি পণ্যের আমদানি, উৎপাদনের মাধ্যমে প্রস্তুত এবং ক্রেতার নিকট বিক্রির জন্য উন্মুক্তকরণ এর প্রতিটি পর্যায়ে যে মূল্য সংযোজিত হয় তার ওপর ভ্যাট প্রদেয় হয়। উপরোক্ত তিনটি পর্যায়ের কোনটিতে কি পরিমাণ ভ্যাট প্রদেয় হবে তা সে সব দেশের কর আদায়কারী কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে থাকেন। এ কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট ভিন্নতর হয়ে থাকে। সংযোজিত মূল্যের ওপর ভ্যাট প্রদেয় বিধায় চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন ক্রেতাকে কখনো একটি পণ্যের সামগ্রিক মূল্যের ওপর ভ্যাট প্রদান করতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে কর আদায়কারী কর্তৃপক্ষ এবং আমদারিকারক, প্রস্তুতকারক ও ভোক্তাদের ভ্যাট বিষয়ে অস্বচ্ছ ধারণার কারণে দেখা যায় একজন ক্রেতাকে সামগ্রিক পণ্যমূল্যের ওপর ভ্যাট প্রদানে বাধ্য করা হয়। একটি পণ্যের আমদানি, প্রস্তুত ও বিক্রয় এ তিন পর্যায়ে ভ্যাট ভিন্নতর হওয়ায় এবং এটির আদায় জটিলতর বিধায় সম্প্রতি পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র ভ্যাট প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে জিএসটি অর্থাৎ গুডস অ্যান্ড সেল ট্যাক্স নামক একটি নতুন ধরনের কর পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। এ কর পদ্ধতিটির প্রবর্তনের ফলে দেখা গেছে ভ্যাটের মাধ্যমে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো এ নতুন ধরনের পদ্ধতির মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। তাছাড়া এ পদ্ধতিটির মাধ্যমে কর আদায় সহজতর বিধায় এটি আমদানিকারক, প্রস্তুতকারক ও ক্রেতা সকলের নিকট সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
কর বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে স্বীকৃত নীতি তা হলোÑ একজন ব্যক্তি কোনোভাবেই একই কর দুবার পরিশোধ করবেন না। আমাদের দেশে আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক কর্তৃক পণ্যের ওপর ভ্যাট প্রদানের পরও ক্রেতার নিকট থেকে সামগ্রিক পণ্যটির ওপর ভ্যাট আদায় করার কারণে একই পণ্যের ওপর দেখা যায় তিনবার পর্যন্ত ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। এতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রস্তুতকারক ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্রেতা ।
ভ্যাট নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক কর পদ্ধতি। এটি প্রতিটি পর্যায়ে সংযোজিত মূল্যের ওপর আরোপ করা হলে পণ্যের মূল্য সহনীয় থাকবে এবং একজন প্রস্তুতকারক ও ক্রেতাকে একাধিকবার কর প্রদান হতে রেহাই দিবে। কিন্তু আমাদের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা ভ্যাট আইন ও ভ্যাট আদায়ের পদ্ধতি বিষয়ে সঠিকভাবে অবহিত না হওয়ার কারণে আরোপ ও আদায় উভয় ক্ষেত্রে জটিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ জটিলতা নিরসনের জন্য রাজস্ব বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় হতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে শুধু সংযোজিত মূল্যের ওপর কোন পর্যায়ে ভ্যাটের হার কিরূপ হবে। সামগ্রিক পণ্য মূল্যের ওপর অন্যায় ও বেআইনিভাবে ভ্যাট আদায়ের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আর তাতে ব্যবসায়ী ও ভ্যাট আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা লাভবান হলেও চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ বা ভোক্তা।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান