অপারেশন কাতার : উদ্দেশ্য কী?
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের সঙ্গে স্থল, নৌ ও আকাশপথের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে প্রতিবেশি সৌদি আরবসহ বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইয়েমেন, মালদ্বীপ ও লিবিয়া। এতে স্বকীয় দূরত্ব বজায় রেখেছে কুয়েত ও ওমান। কিন্তু এই সম্পর্ক ছিন্নের উদ্দেশ্যটি কী?
বাস্তবে পারস্য উপসাগরে কাতার ও ইরানের মধ্যবর্তী ৯,৭০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্যাসফিল্ড, যেখানে ৪৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাসের মজুদ বিদ্যমান। প্রাথমিকভাবে সেটাই এ দুটি দেশকে সম্পর্কযুক্ত করেছে। তথাপি গত সোমবার এ দুটি দেশের রাজধানী যথাক্রমে দোহা ও তেহরানের মাঝে নতুন পরীক্ষা উত্তরণের সূচনা করেছে সৌদি আরবসহ সম্পর্কছিন্নকারী দেশগুলো। অজুহাত ‘জিসিসি’ তথা গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলে অবস্থান করে প্রতিবেশি দেশগুলোর নিরাপত্তাকে পক্ষপাতিত্বমূলকভাবে উপেক্ষা করেছে কাতার। ফলশ্রুতিতে সম্পর্কছিন্নে নেতৃত্ব দিচ্ছে সৌদি আরব।
সৌদি আরবের অভিযোগ, তার কাতিফ প্রদেশে ও বাহরাইনে ‘ইরানের মদুতপুষ্ট সন্ত্রাসী গ্রুপ’কে সমর্থন যোগাচ্ছে কাতার; অবশ্য সেটিকে কাতার ‘অতিরঞ্জিত মিথ্যা অপপ্রচারণা’ বলেছে। সৌদি আরব আরো বলেছে, ‘দোহার কর্তৃপক্ষ’ ইয়েমেনে ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র ‘হুতি’ গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে। অথচ কাতার সেখানে নিজের ১,০০০ সৈন্যবাহিনী দিয়ে সৌদি আরবের দু’বছর মেয়াদী তৎপরতায় সহায়তা জোগাচ্ছে।
তবে লক্ষণীয়ভাবে গত সোমবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার পরিচালিত ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য ন্যাশনাল’ তার সম্পাদকীয়তে লিখেছে যে, ‘ইরানি হস্তক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে দোহার আরব প্রতিবেশিদের রক্ত ও সম্পদ বিয়োগান্তের ঘটনা ঘটছে’ এবং ‘তাতে আরব উপসাগরে দোহার কোনো বন্ধু নেই’। এতে দোহাভিত্তিক আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা তেহরানের সঙ্গে আবুধাবীর বিদ্যমান কূটনৈতিক সম্পর্কের উল্লেখ করে বিষয়টিকে ‘অর্থহীন’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘তারপরও কাতারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করা চাই’। একইভাবে কাতারের মন্ত্রিপরিষদ এক বিবৃতিতে প্রথম পাঁচটি দেশের সম্পর্কছিন্নের ঘটনাকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যায়িত করে বলেছে, এই পদক্ষেপের সুস্পষ্ট লক্ষণটি হচ্ছে ‘কর্তৃত্ব স্থাপন’ করা; যাতে কাতার তার স্বাধীন সার্বভৌমত্বের অস্তিত্বটি হারায়।
ইতোমধ্যে কাতারের ৪০ শতাংশ খাদ্য আমদানির স্থলসীমান্তে খাদ্যপণ্য বোঝাই সারি সারি ট্রাক আটকে দিয়েছে সৌদি আরব। ফলে খাদ্য সংকটের আশংকায় দেশটির ক্রেতারা দোকান থেকে দুধ, পানি, চাল, ডিম ও প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে গাড়িভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে মুদ্রাস্ফীতির আশংকা দৃশ্যমান। কাতারের জাতীয় বিমান সংস্থাও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন। তাদের বিমান শুধুমাত্র ইরান ভূখন্ডের উপর দিয়ে চলাচল শুরু করেছে, এমনকী সম্পর্কছিন্নকারী দেশগুলোতে চলাচল বন্ধে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া এ মুহুর্তে বেশকিছু নির্মাণ প্রকল্প, যেমন একটি নতুন বন্দর, মেডিকেল এলাকা, মেট্রো প্রকল্প এবং ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য আটটি স্টেডিয়াম নির্মাণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে; কেননা নির্মাণ সামগ্রীর পারাপার ওই সৌদি আরব সীমান্ত দিয়েই হচ্ছিল। পাশাপাশি সৌদি সরকার বলেছে, সম্পর্কছিন্ন করার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিকরা কাতারে যাওয়া, বসবাস করা বা কাতার হয়ে অন্য কোনো দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের ১৪ দিনের মধ্যে কাতার ত্যাগে বলা হয়েছে। অপরদিকে, ইসরায়েলও কাতারবিরোধী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, সৌদি আরব ও ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বলয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ২৬ লাখ অধিবাসীর এই উপদ্বীপতুল্য দেশটি তার আয়তন ও পৃথিবীর সর্বাধিক মাথাপিছু আয়ের (এক লাখ ত্রিশ হাজার ডলার) অবস্থান বিবেচনায় এবং কাতার এয়ারওয়েজ ও আল জাজিরা টেলিভিশন খ্যাত হয়ে কতখানি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সামাল দিতে পারে, যেখানে গত ২০ বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উন্নয়ন ও মানবিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ, প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি, কূটনীতি এবং মধ্যস্থতায় সিদ্ধহস্ত হতে সক্ষম হয়েছিল।
ইমেইল: নঁশযধৎর.ঃড়ৎড়হঃড়@মসধরষ.পড়স