আক্কেলপুর : অসম্ভব তোমাকে ভাল না বেসে থাকা
আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) রেল স্টেশন। ব্রিটিশ-ভারতের রেল স্টেশন। ১১টি আন্তঃনগর ট্রেন এখানে থামে। ভূতপুর্ব উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক বাবলুর দীর্ঘ দুই বছরের প্রচেষ্টায় এটি সম্ভব হয়। তাছাড়া রেলের জায়গায় রেলের অনুমতি সাপেক্ষে একটি শহীদ মিনার এবং ‘কমরেড আছির উদ্দিন মঞ্চ’ নামে একটি স্থায়ী মঞ্চ তৈরি হয়। এ স্টেশনে প্রতিদিন গড়পরতা এক লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। প্রথম ট্রেন থামার সিদ্ধান্ত হবার পর উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ রোধ করার জন্য নিজেরা টিকিট চেকের দায়িত্বও গ্রহণ করে। তারা রেল ড্রাইভারের কক্ষ থেকে একবার ১৭ জন বিনা টিকেটের যাত্রী পাকড়াও করে। রেল কর্মচারীগণ এ জাতীয় জনঅংশগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বহু হাঙ্গামা হয়। শেষ পর্যন্ত জনগণের সদিচ্ছার জয় হয়।
আক্কেলপুর রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার একজন নারী। নাম খাদিজা বেগম। তিনি ২০০৮ সালে রেলে যোগদান করেন। ১৬-০৫-২০১৭, বেলা ১১-২০ মিনিটে তার রুমে তিনি গতকালের টিকিট বিক্রির হিসাব শেষ করে জানালেন তা মোট ৯৭,০০০ টাকা। তার রুমের ব্রিটিশ সময়ের সিগন্যাল যন্ত্রগুলো দেখার মতো। প্রথম শ্রেণির যাত্রী বিশ্রামাগারটি ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। তিনি আমাদের চা পানে আপ্যায়িত করলেন। প্লাটফরমে হাঁটলাম। অনেক অচেনা মানুষ চির চেনা স্বজনের মতো যেচে আলাপ করল। প্রায় সবাই দেশের অবস্থা জানতে চায়। কই দেশ তো ভাল আছে! মানুষগুলোর মনে কেন এরকম সৃষ্টিছাড়া প্রশ্ন? অনেকের সঙ্গে ছবি উঠালাম। স্টেশনে রয়েছে বেশকিছু বয়সী বৃক্ষ। যার ছায়ায় অনেক মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে।
দুর্যোগের কারণে দিনাজপুর-ঢাকা ট্রেনের প্রায় তিন ঘণ্টা বিলম্ব হয়। ওই তিন ঘণ্টা অনেকের সঙ্গে গল্প করে স্টেশনে কাটাই। খবর পেয়ে আক্কেলপুর ও জয়পুরহাট পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদ নেতৃবৃন্দ-কর্মীবৃন্দ ছুটে আসেন। চা-বিস্কুটের সঙ্গে টুকটাক নানা প্রসঙ্গÑ স্থানীয় সরকার, রাজনীতি ও নির্বাচন; আরও কত কিছু! এক নতুন মুক্ত আড্ডা। অপরিচিতজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডা! মাঝে মাঝে কাচের স্ব গ্লাসে গাভীর ঘন খাটি দুধের চা।
অবশেষে তিন ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেন আক্কেলপুর স্টেশনে পৌঁছাল। জনাব সাইদুর রহমান কবিরাজ, আনোয়ারুল হক বাবলু, আরিফসহ অনেকেই স্টেশনে ছিলেন। সবাইকে বিদায় দিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম। আমি ঢাকা থেকে শুধু ছোট একটি হাত ব্যাগ নিয়েই গিয়েছিলাম। দেখি আক্কেলপুর থেকে আমার জন্য অনেক ব্যাগ, কার্টুন ও ঠোঙ্গা এগুলো আগে দেখানো হয়নি। ট্রেনে উঠতে গিয়েই দেখলাম। সতেজ সবজি, ফল আর সাইদুর সাহেবের হাতেও দেখি একটি পুটলি, তাতে পথে খাওয়ার জন্য ব্রেড, কলা, বিস্কিট। আমি সবার নিখাদ আন্তরিকতায় মুগ্ধ-অভিভূত। একটি রাত এবং দুটো দিনের আতিথিয়েতা কখনো ভুলবার নয়। বাড়ি থেকে খাবার এনে খাইয়ে গেল বাবলু সাহেব, আরিফ আর কুইন মন্ডল। সাইদুর কবিরাজ বয়স্ক মানুষ, এলাকার মুরুব্বি এবং একজন অতি সম্ভ্রান্ত মানুষ। তার হাতেও পোটলা! তিনি উচ্চ পদে সরকারি চাকরি করে অবসরে আছেন। ছেলেমেয়েরা ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্ত তিনি গ্রামে থাকেন। নানা সমাজ কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তারা সবাই ‘সত্যের পথে’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তার উদ্বোধনী উপলক্ষে আক্কেলপুর আসা। পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা একদিন আগেই হয়ে গেছে। এ উপলক্ষে আছির মন্ডল মঞ্চে সুন্দর অনুষ্ঠান হলো। এখানে আরও একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা (যুগ্ম-সচিব) জনাব আবুল কালাম আজাদকে পেলাম। তিনি একটি এবং কবি কুইন মন্ডল তাদের নিজেদের প্রকাশিত দুটি বই দিয়েছিলেন। ট্রেনে স্থিত হয়ে কুইনের কবিতা (নূর-মহল) এবং গল্প গ্রন্থ (অনুকল্প) পড়া শেষ করলাম। ট্রেনে আসতে আসতে একে একে সবার মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। সবই ভালবাসার মুখ, না এখানে কোন মুখোশ নেই। আক্কেলপুরের কবি কুইন মন্ডলের কবিতার কথা দিয়েই আক্কেলপুরবাসীর প্রতি ভালবাসাটা জানাতে চাই। ‘ভুলে যাব, যেতে বলছ যেতে পারি, যদি দাও অপবাদ নৃশংস, অসম্ভব তোমাকে ভাল না বেসে থাকা’। সাপ্তাহিক সত্যের পথে ও আক্কেলপুরবাসীর জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা!
লেখক: অধ্যাপক এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ