ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা বা নিজেকে জাহির করার জন্য উদ্ভট কথা বলা কিছু মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস যা কেউ করে নাম ফুটানো বা কেউ বলে বুঝে না বুঝে, তবে সে বক্তব্য দিয়ে এটাই মনে করে যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা যাহাই হোক না কেন তার বক্তব্যই শিরোধার্য, হোক তা নৈতিকতা বা গণমানুষের চিন্তা-চেতনার বিরোধী। স্বীকৃত মতে, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ যেখানে ধর্মভীরুতা আছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা নেই। বাংলাদেশের ৯২% মানুষ মুসলমান হলেও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সংবিধানের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২ মোতাবেক ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য ৪টি নির্দেশনা রয়েছে যা নিম্নরূপ:
ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।
সকল ধর্মের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদানের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকার পরও একদল লোক দেশকে ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধর্মভীরুদের সাম্প্রদায়িক বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। যে সকল ধার্মিক এদেশের হিন্দু বা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে ‘সংখ্যালঘু’ বানিয়েছে তারাই বাংলাদেশের ধর্মভীরু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক’ বানিয়েছে। সংবিধানে ‘সংখ্যালঘু’ বলতে কোনো ভাষা-পরিভাষা বা অনুচ্ছেদ বা কোনো প্রকার আকার ইঙ্গিত না থাকলেও জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির জন্য ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে ‘সংখ্যালঘু’ আখ্যায়িত করে ফায়দা লুটতে চায় এতে যাদের ‘সংখ্যালঘু’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তাদেরকেই কৌশলে হেয় করে জাতিগত বিভেদটা আরও প্রকট করছে। শুধুমাত্র অশ্লীল ও বেহাল্লাপূর্ণ জীবনযাপনকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই নাস্তিকরা ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে। তারা নাস্তিক; প্রগতি ও সংস্কৃতির নামে উদ্ভট কথা আবিষ্কারের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সমাজে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এ নাস্তিকরা ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধাচারণকে একটি পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাদের কথায় কবিতা, প্রবন্ধে, চেতনায় শুধুই মাত্র ইসলাম ও আল্লাহবিরোধী মনোভাব। এই নাস্তিকরা ‘রূপবান’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করে ‘সমকামিতা’কে উৎসাহিত করেছে, তারা উচ্ছৃঙ্খলতাকে উৎসাহিত করে সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনছে।
যে যার ধর্ম পালন করবে; অন্য ধর্মের অনুসারীরা প্রয়োজনে সহযোগিতা করবে এটাই অসাম্প্রদায়িকতা। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার জন্য নিজের ধর্ম কর্ম ছেড়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ যদি ভিন্ন ধর্মের কারও অধিকার হরণ করে বা নির্যাতন নিপীড়ন করে সেটাই সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মটা যেন নির্যাতন, শোষণ ও অধিকার বঞ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।
ইসলাম ধর্মকে আঘাত করা নাস্তিকদের একটি ফ্যাশন। নিজেদের প্রগতিশীল ও কলকাতা মনস্ক বুদ্ধিজীবীদের আনুকূল্য পাওয়ার জন্যই এটা তারা করে। ফলে নিজেকে ইসলামবিরোধী অতিমাত্রায় প্রকাশ করতে পারলে রবীন্দ্র ভারতী জাতীয় কিছু খেতাব বা সম্মাননা পাওয়া অনেক সহজতর হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে যে যুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল শোষণ ও শোষকের বিরুদ্ধে যে বিরোধিতা হওয়া উচিত ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তা না করে নাস্তিকেরা যুদ্ধ শুরু করেছে ধর্মের বিরুদ্ধে।
পৃথিবীর সেন্ট পারসেন্ট মানুষ মনে করে যে, সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং তার নিকট জবাবদিহিতা রয়েছে। রাশিয়ার আলোচিত লেখক আলেকজেন্ডার সোলঝেনিৎসিন ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করার সময় ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন যে, ‘ঋড়ৎ সব ভধরঃয রং ঃযব ভড়ঁহফধঃরড়হ ধহফ ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ড়ভ ড়হব’ং ষরভব’ মৃত্যুর জন্য তিনি ভীত কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন যে, ‘মৃত্যুর জন্য আমি ভীত নই। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা যান। ওই সময় মৃত্যু আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে। আমার সবসময় আশঙ্কা হয়, আমার লেখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু ৩০-৪০ বছরের মধ্যেই মৃত্যু সম্পর্কে শান্ত স্থির ভাব আমার মাঝে চলে আসে। আমি মনে করি, এটাই স্বাভাবিক। তবে এটাই শেষ নয়।’ সোলঝেনিৎসিন এর শেষ বক্তব্য ‘এটা শেষ নয়’ খুবই অববহ। এতে প্রমাণ হয় যে, আরেকটি জগৎ রয়েছে যেখানে সৃষ্টিকর্তার নিকট জবাবদিহি করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা