ডিয়ার সেলিব্রিটি ক্রিকেটার্স, এরপরেও সেমি দেখবার আমন্ত্রণ রইল
ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ কিংবা বলা উচিত সমগ্র সোস্যাল মিডিয়া, যে কয়টা কাজ করেছে কিংবা আমাদের ভেতর যে পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে, তা হচ্ছে, আমরা একাধারে যেমন সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি অন্যদিকে আবার বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি। ট্রাম্প, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা সাম্প্রতিক ব্রিটেনের নির্বাচন, সবাই কমবেশি দুকলম লিখে জানান দিয়েছি আমরা কত বড় বিশেষজ্ঞ। অন্যদিকে আমাদের মতের বিরুদ্ধে কিংবা আমাদের তাচ্ছিল্য করে কিছু বললেই তাদের ভাসিয়ে দিয়েছি গালিগালাজের বন্যায়। আমাদের সেই স্বভাব এখন ভর করেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে।
সম্প্রতি ইমরান খান মন্তব্য করেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে। তিনি মনে করছেন সেমি ফাইনালে বাংলাদেশ আসায় আকর্ষণ কমে গেল। সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া গেলে তার আকর্ষণ থাকত। তথ্যটি ফেসবুকে বহুল প্রচারিত হলেও কেউই রেফারেন্স দিতে পারছেন না। দুটি ইউটিউব ভিডিও আর একটি অজানা অনলাইন সাইটে এই খবর এসেছে। সো, তথ্যের অথেনটিসিটি নিয়ে সন্দেহ আছে। বলা হচ্ছে, তিনি টুইট করে পরে ডিলিট করে দেন। যদিও কেউই স্ক্রিনশট দিতে পারেননি। তবে তথ্যটি অনেকেই লুফে নিয়েছেন এবং যথারীতি তাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। তিনি কথাটি বলুন আর না বলুন এমন মানসিকতার লোক নেহাত কম না। গতকালকেই তার পরিচয় দিয়েছেন প্রাক্তন ভারতীয় ওপেনার বিরেন্দ্র সেহওয়াগ। তিনি বাংলাদেশকে গোনায় ধরছেন না। ভারত ফাইনালে যাচ্ছেন, ধরে নিয়ে ভারতকে অগ্রিম অভিনন্দনও জানিয়েছেন। সেহওয়াগের ব্যাপারটা অবশ্য অথেনটিক।
বাংলাদেশ দলকে তাচ্ছিল্য করা যাবে না, এমন বলছি না। মাঝে মাঝে খুবই বাজে পারফর্ম করে। আবার এটাও ঠিক, গত বছর তিনেক তাদের পারফরমেন্সে একটা ধারাবাহিকতা এসেছে। বেশকিছু বড় দলকে হারিয়েছে, সিরিজ জিতেছে। তাই বলব এমন মতামত যারা করছেন তাদের মানসিকভাবে এখনো আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে পড়ে আছেন। ক্রিকেট বলতে এখনো তারা বোঝেন এক সময়ের টপ ৮টা দলকে। বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়েকে এখনো তারা একই কাতারে ফেলছেন। তারা ক্রিকেট সম্পর্কে একেবারে খোঁজ রাখেন না, এমনটা মনে করি না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের যে দারুণ অবনতি হয়েছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যে খেলার যোগ্যতাও হয়নি, তা তাদের অজানা থাকার কথা না। প্রশ্নটা হচ্ছে, নতুন উঠে আসা দেশগুলোর প্রতি পুরনো টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর এই অবজ্ঞা কেন?
ক্রিকেট দুনিয়ায় সম্ভবত বেশকিছু সাব ডিভিশান হয়ে বসে আছে। একসময় ক্রিকেট টিম বলতে বোঝানোই হতো টেস্ট খেলুড়ে দলকে। ভালো ক্রিকেটার মানেই, টেস্ট খেলুড়ে প্লেয়ার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কাহিনীর পরিবর্তন হয়েছে। ওয়ানডে ক্রিকেটার বা ওয়ানডে ক্রিকেট টিম ব্যাপারটা একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অনেক ব্যাটসম্যান বা বোলার এখন বিভিন্ন দলে খেলেছেন যারা টেস্ট খেলুড়ে হওয়ার মতো প্লেয়ার না। আবার উল্টোটাও আছে। অনেক টেস্ট খেলুড়ে প্লেয়ার আছেন, যারা ওয়ানডে টিমে সুযোগ পাচ্ছেন না। আর টি টুয়েন্টি এসে তো সব সমীকরণ আমূল পালটে দিয়েছে।
সো, ক্রিকেটকে এখন তিনটি আলাদা খেলা ভাবতে শেখার সময় এসেছে। আর মূল্যায়নও আলাদা আলাদা হওয়ার প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে। ইমরান খান (নাও বলে থাকতে পারেন) বা সেহওয়াগ যা করেছেন, তা হচ্ছে বাংলাদেশের টেস্ট পারফরম্যান্সের জন্য ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন। ব্যাপারটাকে আমি কিভাবে দেখছি? আমি ব্যাপারটাকে দেখছি ‘ইনেভিটেবল’ হিসেবে। এই একই অবস্থা পাড়ি দিতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কাকেও। এমনকি ভারত, পাকিস্তানকেও। ৮৩’র বিশ্বকাপে ভারতকে কেউ গোনায় ধরেনি, ৯২-এ পাকিস্তানকে। আর ৯৬-এ বিশ্বকাপ জেতার আগে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে শুনতে হয়েছে এমন সব তাচ্ছিল্য মেশানো কথাবার্তা। দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বেশকিছু জেতা ম্যাচ হারার পরে তাদেরও শুনতে হয়েছে ‘এদের দিয়ে কিছু হবে না’ টাইপ মতামত। একেবারে শুরুর দিকে, ভারত কিংবা পাকিস্তান যখন টেস্ট খেলা শুরু করে, তখন তাদেরকেও এই একই চোখে দেখা হতো। পরিবর্তন এসেছে, এক সময়ের ক্রিকেটের সুপারস্টার খ্যাত ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করবার পর থেকে। আমরাও ব্যতিক্রম না।
ইমরান খান কিংবা সেহওয়াগ ইস্যুতে বাংলাদেশের ফেসবুকাররা কমবেশি সবাই ব্যাপারটায় ক্ষিপ্ত। হওয়ারই কথা। কেউ কেউ আবার ইমরানের ব্যাপারটার সাথে মুক্তিযুদ্ধ মেশাচ্ছেন। এটা ফেসবুকে খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তবে বাংলাদেশিদের রাগের অন্যতম কারণ, বাংলাদেশ দল হিসেবে এখন তো খারাপ পারফর্ম করছে না। সো, উই ডিজার্ভ রেসপেক্ট। তবে আমি খানিকটা খুশি। আমাদের পারফরম্যান্সের প্রতি একসময়ের যে অ্যাটিচুড, ‘বাচ্চা কাচ্চা টিম, ভুল তো করবেই’ কিংবা ‘নতুন দল হিসেবে খারাপ খেলেনি’ সেখানে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আমরা এখন নব্বইয়ের দশকের সেই শ্রীলঙ্কা টিমের মতো অবস্থায় পৌঁছেছি, যেখানে কমবেশি সবাই ধরে নিচ্ছে, ‘হারানো সোজা, তবে অঘটনও ঘটতে পারে।‘ অ্যাট লিস্ট ওয়ানডেতে।
সো, ইমরান খান কিংবা সেহওয়াগদের কমেন্টের প্রতি, হাউ টু রিয়াক্ট? গালাগালি? বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করতে দেখলে অপর পক্ষের গোষ্ঠী উদ্ধার করা? করা যায়। অ্যাট লিস্ট যদি অপর পক্ষ যেহেতু রিপোর্ট করে ব্লক করার মতো অবস্থায় নাই, কিংবা করবে না বলেই মনে হচ্ছে। কিংবা গালি দিয়ে যদি মনের ঝাল মেটে, তাহলেও করা জায়েজ। তবে এটাও ঠিক, এটা কোনো সমাধান না। তাচ্ছিল্যের বদলা গালি কিংবা ‘আমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেছ তো খবর আছে’ টাইপ অবস্থান আমাদের কি এনে দেবে? দল হিসেবে উন্নত হয়ে যাব? সবার সম্মান আদায় করে ফেলব? তা তো না। এই রেসিস্ট অ্যাটিচুড তো নতুন কিছু না। যুগে যুগে তা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। আর লড়াইটা করতে হবে খেলার মাঠে। এই তাচ্ছিল্যের জবাব দিতে হবে খেলে। সমাধান একটাই, এমন খেলা দেখানো, যেন ইমরান কিংবা সেহওয়াগ বলতে বাধ্য হন, ‘বাংলাদেশ দারুণ খেলেছে।’
পারব? এই সেমিতে? একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি আশাবাদী। ক্রিকেট খেলায় আবেগ জরুরি তবে তার চেয়েও বেশি জরুরি মাথা ঠা-া রাখা। সেমিতে ১৫ তারিখে ভারত হচ্ছে আমাদের প্রতিপক্ষ। তাচ্ছিল্য করলেও সেই খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখা উচিত সবার। তার চেয়েও বড় কথা, এসব তাচ্ছিল্য মার্কা কথাকে বানানো উচিত ‘উৎসাহ’। আমাদের তাচ্ছিল্য কিংবা কটাক্ষ করা হচ্ছে, কারণ, উই ম্যাটার। উনারা অবাক হচ্ছেন, কারণ আমাদের খেলা উনাদের এক্সপেকটেশানের চেয়ে ভালো ছিল। সো, টেক ইট অ্যাজ অ্যান কমপ্লিমেন্ট।
সেমিতে আমরা হয়তো আন্ডারডগ। কারো কারো মতে ডার্ক হর্স। যেভাবেই দেখা হোক, আমাদের হেলাফেলা কেউই করছে না। ভাবছে, ‘হারানো সম্ভব, তবে অঘটনও ঘটতে পারে।‘ তাচ্ছিল্য মার্কা কমেন্ট দিয়ে মানসিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টাটাও কিন্তু এক ধরনের সমীহ করা। ‘খেলে হারানো টাফ হবে, তাই মানসিকভাবে ঘায়েল করা দরকার।’ যে কারণে সেøজিং করা হয়, আর কি। কারণ যা-ই হোক, আই অ্যাম এঞ্জয়িং। পরিশেষে একটাই কথা বলব, ‘সেমিফাইনালটা যতটা একতরফা হবে ভাবছেন, ততটা না-ও হতে পারে। অ্যাট লিস্ট, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী, টাইপ ফাইট দিবে বাংলাদেশ টিম। ‘সো, ডিয়ার সেলিব্রিটি ক্রিকেটার, সেমিফাইনালটা দেখুন। হু নোজ, ইউ মে ফাইন্ড ইট অ্যা লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স। দ্য মোস্ট ইন্টেরেস্টিং গেম ইউ হ্যাভ এভার সিন।’ আর হয়তো খেলা শেষে বলতেও পারেন, ‘হোয়াট অ্যা পারফরমেন্স বাই বাংলাদেশি টিম। আই ওয়াজ টেরিবলি রং অ্যাবাউট বাংলাদেশ।’