সারাদেশে মামলাজট আদালত প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ বিচারকদের
এস এম নূর মোহাম্মদ : সারাদেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৩২ লাখ মামলা বিচারাধীন। আর মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন বিচার প্রার্থীরা। তাই মামলাজট কমাতে আদালত প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন বিচারকরা। গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে ‘আদালত প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিচারকরা এ পরামর্শ দেন। সম্প্রতি ওই সম্মেলনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বিচারকরা বলেন, আদালত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যাবলিই হচ্ছে আদালত প্রশাসন। আদালত প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিচারকদের দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মচারীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আর এর জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
বক্তারা বলেন, আদালত প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এবং আধুনিক আদালত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ডিজিটালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য একটি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডাটাবেস সিস্টেম এবং জেলা ওয়ারি ডাটাবেস সিস্টেম প্রয়োজন। যাতে আদালতের কজলিস্ট, রায়সহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য থাকবে এবং বিচার প্রার্থীরা সহজেই সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। আর বিচার বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট ওয়েব সাইট চালু হলে বিচার প্রার্থীরা আদালতে তাদের আরজি, জবাব, আবেদন, অভিযোগসমূহ সহজেই পেশ করতে পারবেন। তবে এজন্য বিদ্যমান আইনে সংশোধন আনতে হবে বলে জানান বিচারকরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, বিচারককে অবশ্যই নেতৃত্বের গুণাবলি মেইনটেইন ও প্রেজেন্ট করতে হবে। মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির পরিমাণ বেশি হতে হবে। এজলাস সময় বাড়িয়ে দিতে হবে। সিভিল আপিল শুনতে হবে বেলা আড়াইটার পর। তিনি বলেন, বেইলবন্ড বিষয়ে মনিটর করতে হবে। ক্রিমিনাল আপিল মামলায় জামিন না দিয়ে একমাসের মধ্যে রায় দিতে হবে। এছাড়া বিচারকদের সততা ও নিষ্ঠা বজায় রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
এছাড়া বিচারপতি এ, এম, এন বসির উল্লাহ বলেন, প্রত্যেক জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে পুরাতন মামলার তালিকা তৈরি করে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচারকদেরকে সময়মতো আদালতে আসতে হবে। রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। আর রায়ের তারিখ পরিবর্তন করা উচিত না। তিনি বলেন, আদালত প্রশাসনের দক্ষতা নির্ভর করে জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দিক নির্দেশনা এবং দক্ষতার ওপর। তাই তাদেরকে দক্ষ হতে হবে। উচ্চ আদালতে সময়মতো নথি পাঠাতে হবে এবং প্রত্যেক আদেশে কারণ থাকতে হবে।
পটুয়াখালীর জেলা ও দায়রা জজ আবুল কাশেম মো. মোস্তফা বলেন, জেলা জজকে অবশ্যই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে। দুষ্টু স্টাফদের দ্রুত বদলির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাদের কারণে কাজের কোনো সমস্যা না হয়। সেইসঙ্গে আদালতগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি। কিশোরগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ মাহবুব উল ইসলাম বলেন, কর্মচারীদের আন্তঃজেলা বদলির ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে এবং নিয়োগ সঠিক হয়েছে কী না তা হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে মনিটর করার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস.এম.কুদ্দুস জামান বলেন, আদালতে ক্রয় ও নিয়োগের জন্য বিচারকদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। আর এসব করতে গিয়ে বিচারকরা বিচারিক কাজে মনযোগ দিতে পারে না। তাই নিয়োগ ও ক্রয় সংক্রান্ত কাজের জন্য ভিন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।
এর আগে আলোচনার শুরুতেই অংশ নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব বেগম উম্মে কুলসুম বলেন, আদালতের সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা আধুনিকীকরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে জেলা জজ ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্যানেল লিস্ট তৈরি করতে হবে। এছাড়া উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত মামলাসমূহ মনিটরিং করা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি। ডিজিটালাইজেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, ৬৪টি জেলা আদালত ডিজিটাইলাইজড করার বিষয়ে খুব শিগগিরই প্রজেক্ট উপস্থাপন করা হবে যার ব্যয়ভার সরকার থেকে পরিচালিত হবে। আদালত প্রশাসন সংক্রান্ত কয়েকটি নীতিমালা সংশোধনে কাজ চলছে এবং তা বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।
আলোচনা শেষে সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দকী। তিনি বলেন, আদালতের জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসঙ্গে দ্রুত পূরণ করতে হবে শূন্য পদসমূহ। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, যথাযথ ও হস্তক্ষেপমুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন, বার্ষিক পরিদর্শন ও বিচারিক সম্মেলন সঠিক সময়ে সম্পন্ন হলে পরবর্তী বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সহজ হবে। আদালতের ডায়েরি, কজলিস্ট ও রেজিস্টার সমূহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া সকল আদালতে পর্যাপ্ত কম্পিউটার ও আইটি সরঞ্জাম সরবরাহসহ একজন করে আইটি কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শ দেন তিনি। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি