আসুন ‘মাদক’কে না বলি
প্রদীপ মার্সেল রোজারিও
বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের বিপদজনক সমস্যাগুলোর একটি মাদকাসক্তি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের মহাসড়কে চলতে শুরু করা দেশের উন্নয়নের চাকাকে ধ্বংস করে দিতে পারে এ মাদক। মাদক এবং মাদকের অন্ধকার দিকের কথা আমরা সকলেই অবগত আছি। মাদক নিয়ে অতি সম্প্রতি কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটার পর মাদক এবং মাদকাসক্তি নিয়ে জানার পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাই। অল্প সময়ের প্রচেষ্টার ক্ষুদ্র অর্জন পাঠকের সাথে সহভাগিতা করার জন্য এ উপস্থাপনা।
অজ্ঞতার যুগে অন্যায্য অপরাধ ও অপকর্মের পাশাপাশি মদ পানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। মদ পান তখন আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হতো। প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে মদ পান ছিল অপরিহার্য্য। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের বিপদজনক সমস্যাগুলোর একটি মাদকাসক্তি চিকিৎসার প্রয়োজন, সামাজিক বিনোদন, ধর্মীয় উৎসব এবং তান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার অনুষঙ্গরূপে আদি যুগ থেকে মাদকদ্রব্য ব্যবহার হয়ে আসছে। আদিবাসীদের মধ্যে উদ্ভিদ থেকে তৈরী ড্রাগ দ্বারা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। হেরোডোটাস, হিপোক্রাটিস, এরিস্টটল থেকে ভার্জিল, প্লিনি, এন্ডারসনসহ বহু প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকের লেখায় চিকিৎসার জন্য পপি ও আফিম ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের প্রাচীন গুঁড়িখানায় গাছের ছাল-বাকল দিয়ে চোলাই মদ তৈরীর তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে চোলাই মদ, তাড়ি, গাঁজা ইত্যাদির প্রচলন অনেক পুরানো হলেও এগুলোর ব্যবহার মূলতঃ সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সীমিত ছিল। ব্যাপকহারে মাদকের বিস্তার এবং প্রযুক্তির ছত্রছায়ায় লালিত আধুনিক নেশা জাতীয দ্রব্যের ব্যবহার এদেশে খুব পুরানো নয়। সবচেয়ে ভয়াবহ নেশাজাতীয় দ্রব্য মরফিন বা হেরোইনের মতো তথাকথিত স্বর্গানন্দ উদ্রেককারী মায়াবিস্তারকারী নেশা দ্রব্যের অনুপ্রবেশ এদেশে ১৯৮৩ সালের দিকে ঘটে বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত ইয়াবা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল, বিয়ার, হুইস্কি, কোকেন, আফিম, ডায়াজেনাস, নাইট্রোজেনাম ইত্যাদি নেশাজাতীয় দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বহিরাগত অপসংস্কৃতির হাত ধরে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তির ছত্রছায়ায় প্রস্তুত হয়ে এগুলো যুব সমাজকে সবেচেয়ে বেশী আসক্ত করেছে; ধ্বংস করছে তাদের সত্ত্বাকে, দংশন করছে তাদের আত্মাকে। নেশাজাতীয় দ্রব্য মহামারী আকারে প্রবেশ করছে যুব সমাজের মধ্যে।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত? বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা সম্পর্কে তেমন সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে ১৯৯৪ সালে মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিলো ১৫ থেকে ১৭ লাখ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে এই সংখ্যা ১৫ লক্ষ যার মধ্যে ৭০% যুব সম্প্রদায় এবং ১০% নারী। এ পরিসংখ্যান ২৩ বছর পূর্বের। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ বলে অনুমান করা হয়। তবে বাংলাদেশে এ ব্যাপাওে কোন ধারাবাহিক পরিসংখ্যান নেই বলে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।
পরিসংখ্যানে দেখা যায় বর্তমানে ৩০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ সবচেয়ে বেশী মাদকাসক্ত। এ বয়সী মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ। আবার এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছেলে-মেয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এদেশের শহুরে যুব শ্রেণী নানাবিধ আর্থ-মনো-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত। তাই শহুরে যুবশ্রেণীর মধ্যে এর প্রকোপ বেশী। তবে গ্রামেগঞ্জেও নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। শহরাঞ্চলের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, যশোর, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও খুলনা শহরের তরুণদের মাঝে নেশা গ্রহণের প্রবণতা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই এক লক্ষ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ‘মুক্তি’ নামের একটি বে-সরকারী ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার মোহাম্মদপুরেই ২২ হাজার মাদকাসক্ত রয়েছে।
মাদক কি? মাদক ভেষজ দ্রব্য যা ব্যবহারে বা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিস্কজাত সংবেদন হ্রাস পায় এবং বেদনাবোধ কমিয়ে দেয় বা বন্ধ করে দেয়। মাদক দ্রব্যের বেদনানাশ ক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, আনন্দোচ্ছাস, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, শ্বাস-প্রশ্বাস অবনমন, রক্তচাপ হ্রাস, বমনেচ্ছা, বমি এবং কোষ্টবদ্ধতা।
আপনার পরিবারের সদস্য মাদকে আসক্ত কিনা- কিভাবে বুঝবেন? একটি সুন্দর, গোছালো পরিবারের কোন একজন সদস্যের মাদকাসক্তির কারণে পরিবারটি নরক-যন্ত্রণাময় অবস্থায় পতিত হতে পারে। বর্তমান বাস্তবাতায় পরিবারের যে কোন সদস্য যে কোন সময় মাদকের ভয়াবহ গ্রাসে আক্রান্ত হতে পারে। তাই পরিবারের কর্তা-ব্যক্তিদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন তার সন্তান কি করছে, কেন করছে? পরিবারের কোন সদস্য যদি মাদকের পথে পা বাড়ায় তাহলে তার জীবন আচরণে নিম্নে উল্লেখিত পরিবর্তনসমূহ পরিলক্ষিত হবে।
হঠাৎ নতুন বন্ধুদের সাথে চলাফেরা শুরু করা। বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন টাকা চাওয়া। আগের তুলনায় বিলম্বে বাড়ি ফেরা। রাতে জেগে থাকা এবং দিনে ঘুমের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর অস্বাভাবিক আচরণ করা। খাওয়া-দাওয়া হ্রাস পাওয়া এবং ওজন কমে যাওয়া। মিষ্টির প্রক্তি আসক্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং ঘনঘন চা, সিগারেট পান করা। অযথা টয়লেটে দীর্ঘ্য সময় ব্যয় করা। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়া। অস্থিরতা এবং কোন কিছুতে স্বস্তিবোধ না করা। যৌনক্রিয়ায় অনীহা এবং যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। মিথ্যা বলার প্রবনতা বৃদ্ধি পাওয়া। ছোট-খাটো বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে মনোমালিন্য হওয়া। লেখা-পড়া, খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনীহা।
মানুষ কেন মাদকে আসক্ত হয়? মাদকে আসক্ত হওয়ার পেছনে একক কোন কারণ দায়ী নয়। যদি এক নম্বর কারণ চিহ্নিত করতে বলা হয় তাহলে মাদকের সহজ প্রাপ্তি হবে এক নম্বর কারণ। আর এ সহজ প্রাপ্তির পেছনে সর্বদা সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ মাফিয়া চক্র যারা সুকৌশলে এবং স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য এটিকে বাজারে ছাড়ছে। একজন সমাজ-বিজ্ঞানীর মতে, মাদকাসক্তি হলো বাজার অর্থনীতির কুফল যেখানে একদল স্বার্থান্বেষী কালো টাকা লাভের আশায় কাজ করছে। এছাড়াও এর পেছনে রয়েছে আরও নানাবিধ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্বিক কারণ। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শহরায়ন ও নগরায়নের ফলে সৃষ্ট জটিলতা, ছাত্র-রাজনীতিতে ঢুকে পড়া কু-প্রভাব, রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া, আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া, সন্ত্রাস, হতাশা, দ্বন্ধ ইত্যাদি মানুষকে মাদকাসক্ত হতে সাহায্য করছে। এছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের কুসংসর্গ, পারিবারিক, সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতা, মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হওয়া মাদকাসক্তি ভয়াবহ রূপে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা বেশী। ধনীর দুলাল-দুলালীদের কাছে এটি আভিজাত্যের প্রতীক। মাদকদ্রব্যের সম্মোহনে হারিয়ে যেতে এরা ভালবাসে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে এরা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে চায়। রক্ত প্রবাহে মাদকদ্রব্যের জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া এদেরকে প্রদান করে এক উষ্ঞ অনুভূতি। এ পুলক, অনুভূতি, স্বপ্নিল তন্দ্রাচ্ছন্নতা ও নষ্ট আনন্দ এক সময় এদেরকে আসক্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে শিক্ষিত ও সচেতন মাদকাসক্তদের মধ্যে এমন অনেককেই পাওয়া যায় যারা মনে করেন মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মেধা স্বচ্ছ থাকে, কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, ফলে সহজে সাফল্য আসে। মাদকদ্রব্যের গুণাগুণ সম্পর্কিত যুক্তিগুলোর অধিকাংশগুলোই দুর্বল মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে যেমন একটি কারণ থাকতে পারে আবার একাধিক কারণও থাকতে পারে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ দায়ী। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পারিবারিক স্নেহ, আদর, ভালবাসা, পারিবারিক অশান্তি সর্বোপরি অর্থনৈতিক অবস্থা মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে অনুঘটক হিসাবে ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে মাদকাসক্তির প্রভাব ভয়াবহ। মাদকাসক্তি ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করে। কিশোর বয়সে কেউ মাদকাসক্ত হলে তার সুপ্ত প্রতিভা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শ ইত্যাদি থেকে বিচ্যুত হয়ে যখন কেউ মাদক অপসংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় তখন প্রকৃতপক্ষে সে আত্মহননের পথই বেছে নেয়। সমাজের সম্ভাবনাময় একটি অংশ যখন নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তখন উন্নত-অনুন্নত যে কোন দেশের জন্যই তা অত্যন্ত ক্ষতিকর। সমাজ বিশ্লেষকগণ মাদকের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব চিহ্নিত করেছেন। যার সংক্ষিপ্তসার এখানে উপস্থাপন করা হলো: (১) মাদকদ্রব্যের ব্যবহার শারীরিক ও মানসিক দিককে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ করে তেমনি নৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে মাদক ব্যবহারকারীকে অপরাধপ্রবন করে তোলে। কিছু মাদকদ্রব্য রয়েছে যা গ্রহণ করলে উঠতি বয়সের তরুণরা নিজেকে অত্যধিক শক্তিশালী অনুভব করে। আর এ ‘শক্তির’ সাথে বিভ্রান্তি যোগ হলে ঐ তরুণ যে কোন মারাত্মক অপরাধ ও অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে পারে। এদের কেউ কেউ এক পর্যায়ে ছিনতাই, অবৈধ চাঁদা আদায়, মারামারি-চুরি-ডাকাতি-খুন, কালোবাজারি, দেহ-ব্যবসা ইত্যাদি মারাত্মক ও জঘন্য অপরাধমূলক কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। (২) মাদক মাদকাসক্ত ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিককে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পঙ্গু করে দেয়। সেই সাথে ব্যক্তিকে নিঃসঙ্গ ও মর্যাদাহীনের স্তরে নিয়ে আসে। মাদক নির্ভরতা ব্যক্তির স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, রোগ ব্যধি সৃষ্টি করে; ওজনহীনতা, শক্তিহীনতা ও ক্ষুধামন্দায় ভোগায়। এদের কর্মোদ্দীপনা হ্রাস পায়, মতিভ্রম দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যহীন ও কংকালসার হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। (৩) মাদক মানুষের শরীরে বহুমুখী ক্ষতিসাধন করে থাকে। মদের প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি নষ্ট হয়ে যায়, খাদ্য গ্রহণের স্পিহা হ্রাস পায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে আসে, সামগ্রিকভাবে শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, মানুষ অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, মদ ধীরে ধীরে যকৃৎ, কিডনী সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে ফেলে। বর্তমানের এইডস রোগের প্রাদুর্ভাবের সাথেও মদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। মাদক ও মাদকাসক্তি সম্পর্কে আইন কি বলে? মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০-এর ১০(১)-এর বলা আছে- লাইসেন্স ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি কোন ডিস্টিলারী বা ব্রিউয়ারী স্থাপন করিতে পারিবেন না। কোন এ্যালকোহল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহণ, পরিবহন, প্রদর্শন ও ব্যবহার করিতে পারিবেন না। কোন এ্যালকোহল ঔষধ তৈরীর উপাদান হিসাবে ব্যবহার করিতে পারিবেন না। এই আইনের অধীন প্রদত্ত পারমিট ব্যতীত কোন ব্যক্তি এ্যালকোহল পান করিতে পারিবে না; এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে অন্যুন সিভিল সার্জন বা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে কোন সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তি ছাড়া কোন মুসলমানকে এ্যালকোহল পান করার জন্য পারমিট দেওয়া যাইবে না। এ আইনের ৯। (১) ধারায় আরও বলা আছে- এ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কোন মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানী, রপ্তানী, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন অথবা এতদুদ্দেশ্যে কোন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ, অর্থ বিনিয়োগ কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরিচালনা বা উহার পৃষ্ঠপোষকতা করা যাইবে না। কোন মাদকদ্রব্যের উৎপাদনের ব্যবহৃত হয় এ প্রকার কোন দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানী, রপ্তানী, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন ও ব্যবহার করা যাইবে না।
মাদকের ভয়াবহতা হ্রাসে করণীয়। মাদকদ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালান দেশ, কাল, ধর্ম-বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। ধনী-দরিদ্র, উন্নত-উন্নয়নশীল কোন দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন তথা স্কুল, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যেভাবে বিস্তার লাভ করছে এখনই তার লাঘাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে তা নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।
কিন্তু কি করা যেতে পারে। পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এনে মানবিক গুণাবলী সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষার উৎকর্ষ সাধণ করতে হবে যাতে তরুণেরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে এবং চাকুরী প্রার্থী না হয়ে চাকুরী দাতায় পরিনত হতে পারে। মাদকের ভয়ংকর আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষকে মাদক বিরোধী সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তথাকথিত স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের লেজুড়বৃত্তির কবল থেকে ছাত্রসমাজ ও তরুণদের মুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নানা ধরণের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতঃ যুব সমাজকে বিভিন্ন গঠনমূলক ও বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে আগ্রহী করে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধূলা, সাংস্কুতিক কর্মকান্ডের আরও ব্যাপক ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তরুণ সমাজ অনায়াসে এসব কর্মকান্ডে মনোনিবেশ করতে পারে এবং হতাশাগ্রস্থ হওয়া থেকে মুক্তি পায়। এতে মাদক সেবনের মতো ভয়াল থাবা ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে।
এক জরিপে দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের প্রায় ৪০ শতাংশই কোন কোন সামাজিক অপরাধের সাথে যুক্ত। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলে মাদকাসক্তি। আমাদের দেশে যে হারে তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অত্যন্ত ভীতিকর ও আশংকাজনক। এখনই মাদকের লাঘাম টেনে ধরতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না যে পরিবারে কেউ মাদকাসক্ত নয়। আর এমনটা হলে তা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত পরিতাপের এবং লজ্জার বিষয় হবে। আর এ লজ্জার হাত হতে বাঁচতে আসুন, আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক সকল পর্যায় থেকে ‘মাদককে’ না বলি এবং আমার সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই মাদককে ঘৃণা করতে শিখাই।
তথ্যসূত্রঃ
০১. এ.ই.হক, মাদকাসক্তি; জাতীয় ও বিশ্ব প্রেক্ষিত।
০২. আবু তালেব, হেরোইন; আর এক মারণাস্ত্র।
০৩. “স্মরণিকা-মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ১৯৯৬।
০৪. যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিবেদন, ১৯৯৪, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ০৫. সৈয়দ শওকতুজ্জামান, বাংলাদেম সামাজিক সমস্যা: স্বরূপ ও সমাধান। ০৬. স্মরণিকা-১৯৯৩, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা।