বাস্তব জীবনে বইয়ের জ্ঞান
জেমস কিস্কু
যুগ পাল্টেছে পাল্টেনি মনোভাব !! বই পড়া আমার অনেক দিনের অভ্যাস। এক সময় সেটা ছিল নেশার পর্যায়ে। মাঝখানে কয়েক বছর এই অভ্যাসে ধূলা পড়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা অঘটনা আমাকে পড়াশুনার দিকে টেনে নিয়ে আসছে। একদিক দিয়ে আমি খুশিই বলব। কয়েকদিন আমি অনলাইনে পড়াশুনা করলাম কিন্তু কিছু একটা যেন মিসিং মিসিং মনে হচ্ছিল। আমার কাছে থাকা শরৎচন্দ্রের রচনাসমগ্র ২ খন্ড হাতে তুলে নেওয়াতে মনে হলো মিসিং মিসিং ভাবটা যেন কেটে গেল।বইয়ের প্রথম পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল ১৪-৯-২০০৭ বইটি আমি কিনেছিলাম। সেখানে পরিষ্কার হাতে লেখা একটি উক্তি, ‘ওভ ুড়ঁ ংবব ধহু পড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ নু ুড়ঁৎ ংরমযঃ নঁঃ ফড় হড়ঃ ঢ়ৎড়ঃবংঃ রঃ, ুড়ঁ নবঃৎধু ুড়ঁৎ ংড়পরবঃু’ আমার একান্ত কাছের বন্ধু মিন্টু মন্ডলের হাতের লেখা সুন্দর হওয়াতে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলাম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে তাগিদ আমাকে পড়তে ও লিখতে ঠেলে দিচ্ছে তা উপরে উল্লেখিত উক্তির সাথে হুবুহু মিলে যাচ্ছে। এই মিলের ব্যাপরে পরে আসছি।
শরৎচন্দ্রের লেখা আমার বরাবরই খুবই ভাল লাগে। এই ২য় খন্ডের প্রথমে যে উপন্যাস আছে তা হলো পন্ডিত মশাই। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে এক ধরাতে উপন্যাসটা শেষ করলাম। আমার আগের পাড়ার সাথে এখনকার পড়ার কিছু পাথক্যও বুঝতে পারছিলাম। আগে নেশায় পড়তাম । সেখানে বিশ্লেষণ ক্ষমতার একটু অভাব ছিল। এইবার যেন বিশ্লেষণটা আগের তুলনায় বেশী করছি। চরিত্রগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম। লেখক তার লেখনিতে আসলে কি বলতে চাচ্ছেন তাও যেন একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলাম। তবে এখানেও সেই একই ব্যাপার!! যে তাগিদ আমাকে পড়তে ও লিখতে ঠেলে দিচ্ছে তা উপরে উল্লেখিত উক্তির সাথে হুবুহু মিলে যাচ্ছে।
যাহোক এই উপন্যাসের নায়ক পন্ডিত মশায়ের কিছু অভিজ্ঞতা আমাকে বিশেষভাবে আমাকে নাড়া দিল। নায়কের যে অভিজ্ঞতা আমার মনে হলো আমিও সেই অভিজ্ঞতা মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার অভিজ্ঞতা কথা বলার আগে সেই উপন্যাস থেকে প্রাপ্ত নায়কের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে আলোচনা করছি। আলোচিত নায়কের গ্রামে সে সময় ওলাওঠায় (ডায়রিয়া) অনেক মানুষ মরতে লাগল। নায়ক মূলত নিচু বংশের ছিলেন, তবে তাদের যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল। তার উপরে সে পড়াশুনা জানত এবং কিছু ইংরেজিও শিখেছিল। তখনকার সময়ে ওলাওঠায় গ্রামের পরে গ্রাম মানুষ মারা যেত। নায়কদের একটি পুকুর ছিল যা থেকে সবাই পানি নিয়ে পান করত। গ্রামে যখন ওলাওঠা শুরু করল একদিন নায়ক দেখতে পায় গ্রামের ব্রাহ্মনের বিধবা মেয়ে সে পুকুরে মরার কাপড় পরিষ্কার করছে। নায়ক এর ভবিষৎ খারাপ পরিণতি উপলব্ধি করে ব্রাহ্মনের মেয়েকে কাপড় পরিষ্কার করতে না করে। মেয়েটি যখন বাড়িতে গিয়ে তার বাবা তারিনীকে ঘটনা খুলে বলল সে পন্ডিতমশায়ের কাছে গিয়ে বলতে লাগল, ছোটলোক দুটাকা হয়েছে আর দুটো লাইন ইংরেজি জানে বলে ব্রাহ্মনকে অসম্মান করেছে এত বড় স্পর্ধা? তোর বংশ শেষ হয়ে যাবে। নায়ক চেষ্টা করেও জাতাভিমান এই ব্রাহ্মনকে বুঝাতে পারে না কেন কাপড় পরিষ্কার করতে মানা করেছে। ঘটনাচক্রে নায়কের মা ওলাওঠায় মারা যান। যখন নায়কের একমাত্র পুত্র আক্রান্ত হয়ে পড়ে সে নিরুপায় হয়ে এলাকার একমাত্র ডাক্তারের কাছে যায়, যে কিনা আবার ব্রাহ্মন। তারা নায়কের এই অসহায়ত্বের সুযোগ পুরোপুরি নেয়। ব্রাহ্মনকে অসম্মান করার দোষ দিয়ে তাকে অপমানিত করে। ডাক্তার তাকে তারিনীর কাছে যেতে বলে ক্ষমা চাইতে। সে মান-সম্মান ভুলে সেখানে যায়। তারিনী তার ভবিষৎবানী কিরূপে সত্য হচ্ছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকে। নায়ক রাগে, দুঃখে আর অপমানে ফিরে আসে। বেচারা তার একমাত্র পুত্রকে হারায়।
এখন আসি আমার অভিজ্ঞতায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমার এলাকার কিছু ঘটনায় আমি তারিনীদের মুখোমুখি হয়েছি। তারা আশা করে আপনার থেকে বড় বলে তারা ভুল করলেও সব ঠিক। আপনি যদি বলেন আপনি যেটা বলছেন সেটা ঠিক না ওই টা ঠিক। সাথে সাথে বলে দিবে তুমি বড়দের সম্মান করতে জান না? তোমার মা বাবা তোমাকে বড়দের সম্মান করতে শেখায়নি? কলেজে পড় আর এই কেমন ব্যবহার। তোমার চেয়ে কি আমরা কম বুঝি? এই জাতীয় অনেক কথা। এই মানুষ গুলোর সংখ্যা আমাদের সমাজে খুব কম না। তারা বুঝে না, তাদের ভুলের জন্য সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করে আছে। তারা অন্যকে ছোট করে নিজেরা গর্ববোধ করে। পারলে হিংসায় আপনাকে সমাজচুক্ত করে। ব্যক্তিগত শিক্ষা থেকে ওদের অনেক সময় সামনাসামনি মোকাবেলা করি। কখনও বা মনে হয় কি হবে সত্য বা সঠিক কথা বলে? পরক্ষণে আবার বিবেক জাগ্রত হয়ে বলে গুরুজনকে সম্মানের নামে যেন তাদের অন্যায়কে স্বীকার করে না নেওয়া হয়। বরং তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করা উচিত নয় কি?