বাবার আশীর্বাদ জীবনের পাথেয়
আজ ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। ইংরেজিতে ফাদার বা ড্যাড, জার্মানিতে ফ্যাটা, বাংলায় বাবা কিংবা ভারতীয়দের ভাষায় পিতাজিÑ যে নামেই ডাকা হোক না কেন পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা একই রকম। এজন্য জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস উদযাপিত হয়। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর জন্যই এই দিবস। যদিও বাবার প্রতি সন্তানের চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও পৃথিবীর মানুষ বছরের একটা দিনকে বাবার জন্য রেখে দিতে চায়। যেমনটা মায়ের জন্য ‘মা দিবস’ আছে।
দুই. এ দিনটি সামনে রেখে আমাদের ছাত্র ফেরদৌস হাসান রাসেল তার বাবার গল্প করছিল। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। বড় সন্তান হিসেবে ফেরদৌস তার বাবার অপত্য স্নেহের কথা বলছিল বারবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিংবা যে কোনো সংকটে বাবার ছায়াতলে আশ্রয়ের কথা স্মরণ হলে ওর চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। বেকার জীবনে পিতা তার চাকরি পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছেন, আশায় বুক বেঁধে ওর জন্য পারিবারিক জমি বন্ধক রেখেও সংসার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে আমাদের ছাত্রী মিশু খুবই বাবা অন্তপ্রাণ। নরসিংদীর মেয়ে ঢাকায় মেসে থেকে লেখাপড়া করছে। ভাল ছাত্রী। বাবার জন্য সে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে। আর পিতার নানান নির্দেশ মেনে চলতেও বাধ্য সে। বেশি ঘোরাফেরা করবে না, কাউকে সঙ্গে না নিয়ে দূরে যাবে না, এ রকমভাবে বাবার আরও কত কথা তার শিক্ষা জীবন ঘিরে আছে সবসময়। ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গানটি মিশুকে এক অসীম নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে দেয়।
আমার বাবা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ছয় ভাইবোনের খাবার জোটাতে তাকে অপরের কাছ থেকে ঋণ করে সংসার চালাতে দেখেছি। এমনকি আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে তাকে বাস্তুভিটা বিক্রি করতে হয়েছে। পিতার স্বভাব কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ঋণ করে চলাও আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মিথ্যা কথা না বলা, সাধারণভাবে জীবনযাপন করা, বিলাসিতা বর্জন করা বাবার কাছ থেকে শিখেছি। বাবার আশীর্বাদ ও উৎসাহ না পেলে লেখার কাজেও এগিয়ে আসতে পারতাম না। কথায় বলে, বটবৃক্ষ কিংবা নিদাঘ সূর্যের তলে সন্তানের কোমল-শীতল ছায়া হলেন বাবা। বাইবেলে আছে, ‘কারও সন্তান যদি রুটি চায় তাহলে সেই পিতা কি তাকে পাথর দেবে? কখনো নয়।’ কারণ পিতা সন্তানের জন্য তার জীবনের সবটুকু উৎসর্গ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে দেন।
মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার যেমন ‘বিশ্ব মা দিবস পালিত হয় তেমনি এদেশেও ‘বাবা দিবস’ বেশ ভালোভাবেই উদযাপন করা হচ্ছে। দেশের মিডিয়া ও ফ্যাশন হাউসগুলো দিবসটিকে ঘিরে নতুন পোশাক বাজারে নিয়ে আসে। সন্তান বাবাকে নানারকম উপহার দিয়ে দিনটি পালন করে। বাবা মানেই কর্মব্যস্ত একজন মানুষ। বাইরে থেকে ফিরে যিনি সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে ভুলে যেতে পারেন সারাদিনের ক্লান্তি। ‘বাবা দিবসে’ মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পের কথা। রবীন্দ্রনাথ এ গল্পে পিতৃ হৃদয়ের স্নেহকে ধর্ম-বর্ণ-দেশের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। আফগান কাবুলীওয়ালা রহমতের পিতৃত্বের মহিমা বাঙালি পিতার বাৎসল্যকেও হার মানিয়েছে। তাই মিনির বাবার মতে, ‘দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, হাতে খানিকটা ভূষা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশু হস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে।’ পরক্ষণে মিনির বাবা বুঝতে পারলেন, ‘সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা।’ সন্তানের জন্য পিতার এই হাহাকার দীর্ণ হৃদয়ের চিত্রণ চিরন্তন, অনবদ্য।
চার. বাবা দিবসে আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হোকÑ বাবা আমরা তোমাকে ভালোবাসি। যে দায়িত্ব নিয়ে তুমি আমাদের মানুষ করে তুলেছো, আমরা তা ভুলিনি, ভুলবো না কোনোদিন।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়