ধান-চালের কৃত্রিম নয়, যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি মানা যায়
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ধান-চালের মূল্য কম বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশে সরকার এবং বিরোধী পক্ষ যার যার মতো কথা বলছেন। এতে পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক নানা কথা উভয়পক্ষই বলে থাকেন। এতে সমস্যার মূলে যাওয়ার কোনো আন্তরিকতার প্রকাশ পায় না। বরং চাল নিয়ে রাজনীতি করার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। দেশে এখন ধান চালের মূল্য বাস্তবতার চাইতে বেশি বেড়েছেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই বাড়তিটা ঘটিয়েছে আড়ৎদার, চাতালের মালিক এবং চাল ব্যবসায়ীরা। ধানের দাম কিন্তু চালের তুলনায় বেশ কমই বলা চলে। ধান যেহেতু কৃষকের ঘরে, কৃষকের বাজারজাত করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে মজুতদার, চাতালের মালিক, ফড়িয়া এবং বাজারের ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাজারে চাল সরবরাহের ক্ষমতা রাখে, বাজার ওঠা-নামার কারসাজি তাদের হাতেই রয়েছে, ভোক্তারা যেহেতু বাজার থেকে চালই বিশেষভাবে কিনে থাকে, ধান কিনে চাল করার ঝামেলা খুব কম ভোক্তাই নিয়ে থাকে। তাই বাজারে ধানের চাইতে চালের দাম বাড়ানো কমানোর সুবিধা যেমন বেশি, ক্ষমতাও বেশি। সেটিই ঘটে চলেছে। এ সময়ে চালের দাম যেভাবে বেড়েছে তার সুবিধা উৎপাদনকারী কৃষক খুব একটা নিতে পারছে না, যারা ধানকে চাতালে নিয়ে চালে পরিণত করার পরিশ্রম করতে পারেন তারা কিছুটা বাড়তি সুবিধা পেতে পারেন। তবে তাতেও পরিবহন এবং শ্রমিকের মজুরি বাবদ বাড়তি খরচের নানা হিসাব-নিকাশ রয়েছে।
এসব বিবেচনায় ধানের সরাসরি উৎপাদক কৃষকরা আশানুরূপ লাভ করার সুযোগ কমই পেয়ে থাকে। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগী চাতালের মালিক, মজুতদার, আড়ৎদার ও বাজারের ছোট-বড় চালের ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি চালে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে যে যার মতো করে লাভ করে থাকে। অন্যদিকে কৃষকের ভাগে ধান উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ অবধি খরচের নানা খাত অতিক্রম করতে হয়। তাতে ধান গোলায় তোলা পর্যন্ত মোট যে খরচ পড়ে তা বাজারে বিক্রি করে কৃষক খুব কমই খরচ তুলে আনতে পারে। সরকার নানা ধরনের ভর্তুকি প্রদান করার পরও দিনমজুরের মজুরিসহ নানা ধরনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের প্রকৃত উৎপাদন খরচ পুষিয়ে কৃষক বাড়তি কিছু অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বেশ টানাটানিতে থাকে, অথচ চাল ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি সুযোগ বুঝে যখন কয়েক টাকা লাভ হাতিয়ে নেয় তখন উৎপাদকের চাইতে মধ্যস্বত্ব ব্যবসায়ীরাই সবচাইতে লাভবান হয়, দ্রুত টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে। এ বছর ৭টি জেলায় হাওরের ফসলহানি, ১৬টি জেলায় পোকার আক্রমণে ধানের ফলন হঠাৎ করেই কমে যায়, যা একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে। সেই সুযোগটি পুরোদস্তুর নিয়েছে চাতালের মালিক, মজুতদার, আড়ৎদার, বাজারের বড় ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। প্রকৃত কৃষকগণ এই মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা সামান্যই কাজে লাগাতে পারছে।
অন্যদিকে কম আয়ের মানুষ, দিনমজুর এবং ছোট কৃষকদেরকেই হঠাৎ চালের বাড়তি দামের কারণে কিছুটা হলেও সংকটে পড়তে হচ্ছে। চালের দৈনিক ক্রেতায় তাদের অংশই বড়, তাই বাড়তি অর্থ তাদেরই বেশি গুনতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে চালের ব্যবহার যেমন কম চালের জন্য বাড়তি টাকা গুনতে তাদের খুব বেশি সমস্যা হয় বলে মনে হয় না। যারা চালের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বেশি কথা বলেন তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অথচ তারাই এ নিয়ে কথা বলেন বেশি। কিন্তু যেটি দেখা হয় না তা হচ্ছে শ্রমজীবী থেকে উচ্চবিত্ত মানুষের আয় ৪/৫ বছরে তথা নতুন বেতন স্কেলে কতটা বেড়েছে, ধান চালের প্রকৃত উৎপাদন খরচ কতটা বেড়েছে, বাজার মূল্য কৃষক কতটা পাচ্ছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা কতটা বেশি লুটে নিচ্ছে, ভোক্তারা প্রকারভেদে চালের জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেন তা কতটা কার জন্য সহনীয়, কতটা অসহনীয় হচ্ছে ভাবা দরকার। তা না হলে ধানের উৎপাদন এমনিতেই কমে যাবে, কৃষক অন্যকিছু উৎপাদনে উৎসাহী হতে বাধ্য হবেন, সেক্ষেত্রে চালের মূল্য কারোরই নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে বলার কিছু থাকবে না। সে কারণে আমাদের সবার উচিৎ কাজ হচ্ছে ধান-চাল নিয়ে অযৌক্তিক কথাবার্তা বাদ দিয়ে মাঠের আসল চিত্রটি মাথায় নিয়ে কথা বলা, ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়