হেলথ সিস্টেম ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা ও সম্ভাবনা
ডা. মো. শাহিনুল আলম
আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিভিন্ন রকম সমস্যা, সংকট আমাদের এখানে রয়েছে। স্বাস্থ্যখাতও এর বাইরে নয়। স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা যেমন রয়েছে, আছে অনেক অর্জনও। সম্ভাবনাও আছে বিপুল। আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সবকিছু নিয়েই আসলে আমাদের স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ভালো কিছু দিক বলে নিই। ভালো দিকের মধ্যে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অ্যাসিভমেন্টের স্বাস্থ্যগত যে অবস্থানগুলো ছিলÑ চাইল্ড মডেলিটি, ফ্যাকসিনেশন এসব জায়গায় আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। অমর্ত্য সেন তার লেখা বইয়ে বারবার উল্লেখ করেছেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের তুলনা করে তিনি অবাক হয়েছেন। এ খাতে বাংলাদেশের অর্জন এত বেশি কিভাবে সম্ভব? বিশেষ করে এই অংশটুকু।
লেনসেট একটা ব্রিটিশ জার্নাল, হেলথ বিষয়ে সারাবিশ্বে প্রচারিত বিখ্যাত একটি জার্নাল। তারাও বলেছে যে, এটা খুবই অসাধারণ ঘটনা বাংলাদেশের মাথাপিছু অথবা জিডিপির হারে বাংলাদেশের হেলথ বাজেট ক্রমাগতভাবে কমছে। কিন্তু অর্জন বাড়ছে। তাদের ভাষায় এটা একটা বিস্ময়কর বিষয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার যে হেল্থ সার্ভিস ইনডেক্স করেছে, সেখানে আমরা ৭৭ নম্বরে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবার উপরে। ভারত আমাদের পিছনে। সেনিটেশনে আমরা এগিয়ে। এসব দিয়ে হয়তো আমরা একটা মানসিক শক্তি তৈরি করতে পারে, যেসব চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনের রয়েছে মোকাবিলা করার।
ভারত কিছু বিষয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে আছে। আর হিউম্যান রিসোর্সের দিক থেকে তারা আমাদের থেকে এগিয়ে। হেলথ-এর খুব সাম্প্রতিক অর্জনগুলো আমাদের চেয়ে ভালো। পুরো ভারতকে কল্পনা করলে, তাদের টুটাল ডিস্ট্রিবিউশনটা হলো অসম। দিল্লি, মুম্বাই, মাদ্রাজের কথা যদি আমরা ধরি তাহলে এসব জায়গায় তারা অনেক এগিয়ে। কিন্তু সেভেন সিস্টারের দিক দিয়ে তারা অনেক পিছিয়ে। যার কারণে তাদের স্বাস্থ্যখাতের এভারেজটা আমাদের চেয়ে নিচে নেমে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতের ইদানিংকালের জন্য, টেকনিক্যাল সার্পোটে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
আমাদের এখানে সাধারণ মানুষের সচেতনতার জায়গাটা সব জায়গায় ভালো নয়। আমাদের যত মানুষ অসুস্থ হয় তার মাত্র ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার কাছাকাছি আসেন। বাদবাকিরা নিজেদের মতো করে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা রেখে চলে। এই যে বড় একটা সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে আসলেন না আর যারা আসলেন সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা মিলিয়েও তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই আমাদের। বিএমএ রেজিস্টারকৃত আমাদের চিকিৎসক রয়েছেন ৭০ হাজার। এই ৭০ হাজার চিকিৎকও আবার রোগী দেখছেন না। ৭০ হাজার চিকিৎসকের মধ্যে হয়তো ৪০ হাজার চিকিৎসক রোগী দেখছেন। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ৪০ হাজার চিকিৎসক, সংখ্যাটা খুবই কম।
২০১৫ সালে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৫ কোটিরও বেশি রোগী ভিজিট করেছেন। ৫ কোটি ভিজিট চিকিৎসকদের ফেস করতে হয়েছে। ৪০ হাজার চিকিৎসকের মধ্যে সবাই আবার সরকারি নয়। এর মধ্যে হয়তো ৩০ হাজার সরকারি, বাকিরা বেসরকারি। হিসেব করলে এভারেজে প্রতিটি রোগী ৫ মিনিটের বেশি সময় পান না। জনবল ও সামর্থ্যরে দিক আমরা প্রতিবেশীদের চেয়ে আমরা পিছিয়ে আছি।
চিকিৎসা সেবায় ব্যয়ের বিষয়টি বহুল আলোচিত। এখানে রোগী ও সরকারের ব্যয় করবে? সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৬৫ শতাংশ রোগী নিজের পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে, ৩৫ শতাংশ অর্থ সরকার বহন করে। আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বাজেট হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা আর প্রতি বছর ঔষধ বিক্রি হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের চেয়ে বেশি ঔষধ বিক্রি হয়। তাহলে একটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার সামর্থ্য কিভাবে বাড়বে বলুন।
আমাদের একটা সমস্যা হচ্ছেÑ আমাদের ব্যক্তিগত কোনো হেলথ বাজেট নেই। ফলে যখনই আমরা বিপদে পড়ি তখন ক্যাশ টাকাটা শেষ হয় আমাদের। তারপর আত্বীয়স্বজন থেকে ধারদেনা করি। সম্পদ বিক্রি করি। বিশ্বব্যাংকের একটি হিসাব বলছে, প্রতি বছর ৬৪ লাখ লোক বাংলাদেশে গরিব হচ্ছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে। গ্রাম থেকে যারা চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য শহরে আসেন তাদের অনেকেই মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা আনেন। সুদের হার প্রায় ২০০ শতাংশ। এতে মধ্যবিত্ত গরিব হচ্ছে, গরিব নিঃস্ব হচ্ছে। সুদের টাকাটা গরিব মানুষটি কখনো পরিশোধ করতে পারে না। তাদের ঘর বিক্রি করে দিতে হয় চিকিৎসার জন্য, ৬৪ লাখের মধ্যে এমন লোকও রয়েছেন।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন দেশে ইন্সুরেন্স ব্যবস্থা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইন্সুরেন্স সিস্টেম, আর ইউরোপে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা ট্রার্স্ট। সরকারের বাজেটা সেই ট্রাস্টে যায়। ইউকে কিংবা ইউরোপের কোথাও শুনবেন যে তারা কোনো প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে গেছেন। সেসব দেশে কোনো প্রাইভেট চিকিৎসক নেই, সব সরকারি হাসপাতেলই চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে সবাই। স্বাস্থ্যখাতের এই ব্যয় সরকার অথবা ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো দিচ্ছে। ইন্সুরেন্স সিস্টেমের মেক্সিমাম ব্যয়ই বহন করতে হবে সরকারকে। তা না হলে ইন্সুরেন্স কোম্পানি চিকিৎসা সেবার উপর প্রভাব বিস্তার করবে, চিকিৎসকরা সঠিক চিকিৎসাটি দিতে পারবেন তখন। ইতোমধ্যে সরকার টাঙ্গাইলের দিকে ইন্সুরেন্স সিস্টেম চালুন করেছে। এই উদ্যোগ খুবই ভালো। এটা যদি সফল হয় তাহলে গরিব মানুষদের খুবই সুবিধা হবে।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মানুষের অধিকার। মৌলিক এই অধিকার পূরণে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। চিকিসা সেবার জন্য সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। মানুষের খরচ কমানো। চিকিৎসা কারিকুলামও আগের চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে। রোগী ও চিকিৎসকদের সম্পর্কের মধ্যে যে টানাপোড়েন, যোগাযোগের যে শূন্য সেই জায়গাটা যাতে না থাকে তার জন্য চিকিৎসক, নার্স ও হেলথ ওয়ার্কার যারা তাদেরকে সার্ভিস দেওয়ার ক্ষেত্রে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটু মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই জায়গাটা আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে, তবে আরও উন্নতির জায়াগা রয়েছে। প্রতি বছর যে পরিমাণ চিকিৎসক পাস করে বের হচ্ছেন তার মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যদি অন্য পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্মানজনক অবস্থান যদি না থাকে তাহলে চিকিৎসকদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়বে ভবিষ্যতে। মেধাগুলো চলে যাবে বিদেশে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : আশিক রহমান