‘পলিটিক্স অব অ্যানিহিলেশন’
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে আমরা ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক ধারাই কেবল লক্ষ্য করছি। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাই। এখানে একটি রাজনৈতিক শক্তি আরেকটি রাজনৈতিক শক্তিকে সহ্য করতে পারে না; এবং রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের ধ্বংস কামনা করে এবং সত্যিকার অর্থেই ধ্বংস করার জন্য বোমা হামলা, গুম, খুন ও হত্যা প্রচেষ্টার মতো ঘৃণ্য-প্রাণান্তকর উদ্যোগও নেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একেই বলে ‘পলিটিক্স অব অ্যানিহিলেশন’ বা ধ্বংসের রাজনীতি। কিন্তু ভুলে গেলে ভুল হবে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে বিনাশ করে আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকতে পারে না। দ্বান্দ্বিকতার নিয়মেই পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তির টিকে থাকা জরুরিÑ সমাজ প্রগতির অভিযাত্রার এটাই হলো বিজ্ঞানসম্মত পথ- থিসিস, অ্যান্টিথিসিস আর সিনথিসিস। কিন্তু নয়-প্রতিনয়-সমন্বয়ের বিপরীতে নিকট অতীত ও বর্তমান অবস্থায় আমরা শুধু ধ্বংসের রাজনীতিই দেখছি। সবশেষ পাহাড়ধসে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে রাঙামাটি যাওয়ার পথে বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলা এর নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যাকা-, একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের হত্যাকা-, সালাহউদ্দিনের নিখোঁজ নাটক, নির্বাচিত মেয়রদের জেলে পুরে দেওয়া ইত্যাদি ন্যক্কারজনক ঘটনা আমরা দেখেছি। তারও আগে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করা কিংবা জঘন্যভাবে জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে খুনের ঘটনা আমাদের মনে এখনো জাজ্বল্যমান। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একবারও কি ভেবে দেখেছেÑ সকল বিরোধী চিন্তা ও রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংস হলে রাষ্ট্র ও সমাজ প্রগতির কী হবে? রাজনীতিতে যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হবে তার পরিণতি কী হবে, সেটা কী ভেবে দেখা হয়েছে? ক্ষমতার ধরনই এমন যে, যে কারও হাতে পড়লেই তা স্বৈরাচারী কাঠামোয় রূপ নেয়। এজন্যই পলিটিক্যাল ফিলসফাররা ক্ষমতাকে পাহারা দিয়ে রাখার কথা বলতেন। ক্ষমতার চেক-অ্যান্ড-ব্যালান্স বা ভারসাম্য না থাকলে স্বৈরাচারী মানসিকতা, ইলেক্টরাল অটোক্রেসি আর প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব তৈরি হয়। তৈরি হয় জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদ। দেশ পরিচালনা আর দেশকে সাংস্কৃতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক কাজ নয়। দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সমান্তরালে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। সবার কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। গণতন্ত্র মানেই ‘মাল্টিপল ভয়েসেস’Ñ বহুস্বর, বহুকণ্ঠ, বহুমত; এই বহুত্ববাদই ‘বিউটি অব ডেমোক্রেসি’Ñ গণতন্ত্রের মুখ্য সৌন্দর্য্য। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্যই সমাজে তর্ক আর প্রশ্ন তোলা জরুরি। কারণ তর্কহীন আর প্রশ্নহীন সামজ মানে মৃত সমাজ। দ্বিমত ও ভিন্ন মতাদর্শকে মূল্য ও মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই গণতন্ত্রের সঠিক রূপ আমাদের কাছে ধরা দেবে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য সর্বাগ্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে এই পলিটিক্স অব অ্যানিহিলেশন বা ধ্বংসের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণের ভোট ও মতামতের উপর আস্থা রাখতে হবে। গ্রেনেড, বোমা বা গুম-খুন করে বিরোধী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ৎড়নধবঃ.ভবৎফড়ঁং@মসধরষ.পড়স