
অম্বুবাচী ধরিত্রী মাতার প্রতি শ্রদ্ধা
া পূজন চন্দ্র বিশ্বস
অম্বুবাচী হিন্দুধর্মের বাৎসরিক উৎসব। অম্বুবাচীকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অমাবতিও বলে। হিন্দুদের শাস্ত্রে পৃথিবীকে মা বলা হয়ে থাকে। বেদেও একই রকমই তাকে মা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, আবার পৌরানিক যুগেও পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী বা ধরিত্রী মা ঋতুময়ী হয়। সেই সময়টিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। অর্থাৎ এই প্রচলিত আচারের পিছনে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী আমাদের মা এই বিশ্বাস রয়েছে। তার কারণ পৃথিবীতেই তো মানুষের জন্ম, শুধু মানুষ বলে নয় ফুল, পাখী, প্রকৃতি এক কথায় সকলেই তো পৃথিবীর সন্তান। মহাজাগতিক ধারায় পৃথিবী যখন সূর্যের মিথুন রাশিস্থ আদ্রা নক্ষত্রে অবস্থান করে সেদিন থেকে বর্ষাকাল শুরু ধরা হয়। পাশাপাশি আমরা জানি মেয়েদের ঋতুকাল বা রজঃস্বলা হয় এবং একজন নারী তারপরই সন্তান ধারনে সক্ষম হয়। ঠিক তেমনি প্রতিবছর অম্বুবাচীর এই তিনদিনকে পৃথিবীর ঋতুকাল হিসেবে ধরা হয়।
ধর্মীয় আচার হলেও এরসঙ্গে প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থা জড়িয়ে থাকায় এটির একটি সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। ফলে অম্বুবাচী একটি কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠানও। এর অর্থ ধরিত্রীর ঊর্বরাকাল। দেখা যায় এই তিনদিন জমিতে কোনও রকম চাষ করা হয় না যাতে বর্ষায় সিক্তা পৃথিবী নতুন বছরে নতুন ফসল উৎপাদনের উপযোগী হয়ে ওঠে। উর্বরতা কেন্দ্রিক কৃষিধারায় নারী এবং ধরিত্রী সমর্থক বলে গণ্য করা হয়। সেই ধ্যান ধারণা থেকেই আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী বা মাতা বসুমতি যখন বর্ষার নতুন জলে সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে ঋতুমতি নারী রূপে গণ্য করা হয়। তখন শুরু হয় অম্বুবাচী প্রবৃত্তি, ঠিক তিন দিন পরে সেটা শেষ হয়, সেটা হল অম্ববুচি নিবৃত্তি। প্রাচীন কাল থেকেই এই নিবৃত্তির পরই ফের জমিতে চাষ আবাদ করতো কৃষকেরা। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ঋতুকালে তো মেয়েরা অশুচি থাকে। একই ভাবে পৃথিবীও এই অম্বুবাচী বা অমাবতির তিন দিন অশুচি থাকে বলে ধরে নিয়ে চাষিরা আর মাঠে যান না হাল টানতে। এখনও বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ম রক্ষা হয়।
আবার এ সময় যারা ব্রহ্মচর্য পালন করেন যেমন: ব্রহ্মচারী, সাধু সন্ন্যাসী, যোগীপুরুষ, বিধবা মহিলা কোনও ভাবেই আমিষ খাদ্য গ্রহণ করেন না নিরামিষ খেয়ে থাকেন। যেহেতু এরা কেউই অশুচি পৃথিবীর উপর আগুনের রান্না করা কিছু খান না। বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে এই তিন দিন কাটান। এই কারণে এখনও পরিবারে বয়স্ক বিধবা মহিলাদের তিনদিন ধরে অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে ব্রত পালন করতে দেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অম্বুবাচী পড়ার আগে রান্না করে রাখা হয় পরের তিনদিন খাওয়ার জন্য, যেহেতু অম্বুবাচী শুরু হয়ে গেলে রন্ধনের নিমিত্তে আগুণ জ্বালানো বারণ। এই প্রচলিত বিশ্বাসের ফলে অম্বুবাচীর তিনদিন পর্যন্ত কোনো ধরনের মাঙ্গলিক কার্যই করা যায় না। চতুর্থ দিন থেকে মাঙ্গলিক কাজে কোনও বাধা থাকে না। অম্বুবাচীর সময় হাল ধরা, গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ইত্যাদি শুভ কাজ করা নিষিদ্ধ থাকে এবং এই সময়ে মঠ-মন্দিরের প্রবেশদ্বার বন্ধ থাকে। সাধারণত দেখা যায় ৭ থেকে ১১ আষাঢ় (নিরয়ণ পঞ্জিকা মতে) চার দিন গ্রাম-বাংলার মহিলারা এই অনুষ্ঠান পালন করেন।
অম্বুবাচীর সময় হিন্দু ধর্মীয় লোকেরা শক্তি পূজার স্থানগুলোতে এই সময় অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করে থাকে। তবে এদের মধ্যে সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারতের অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের কামাখ্যা দেবীর মন্দিরকে ঘিরে প্রতি বৎসর অম্বুবাচী মেলার আয়োজন করা হয়। অম্বুবাচী শুরুর প্রথম দিন থেকে কামাখ্যা দেবীর দ্বার বন্ধ রাখা হয় ফলে অম্বুবাচীর সময় দেবী দর্শন নিষিদ্ধ থাকে। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা সম্পূর্ণ হওয়ার পর কামাখ্যা মাতার দর্শন করার অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের থেকে আসা লক্ষ লক্ষ ভক্তেরা এই সময় কামাখ্যা মন্দিরের চতুর্দিকে বসে কীর্ত্তন চলে। মন্দিরের বাইরে প্রদীপ ও ধূপকাঠী জ্বালিয়ে দেবীকে প্রনাম করেন। অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন পান্ডারা ভক্তদের রক্তবস্ত্র উপহার দেন। কামাখ্যা ধামের অম্বুবাচী মেলা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
