
শ্রীমদ্ভগবদগীতার সারমর্ম
া ধীরেন্দ্রনাথ বারুরী
পরস্পর বিরোধী কর্ত্তব্যের চাপে ভাঙ্গে পড়েছেন অর্জ্জুন। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি কর্ত্তব্য বলতেছে, ‘যুদ্ধ কর’। পারিবারিক কর্তব্যের দাবি পিতামহ, গুরু, আত্মীয়-স্বজনকে মারা উচিত নয়। যারা পূজার পাত্র ভীস্ম, দ্রোণ তাদের বধসাধন কেবল অন্যায় নয়, অত্যন্ত বেদনাদায়কও বটে। সমস্যা এই- কর্তব্যের মধ্যে বিরোধ। একটা কর্ত্তব্য পালন করতে গেলে, অন্যটা সম্ভব হয় না। কোনটা শ্রেয়, করা উচিত, তা অর্জুন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই ভেঙ্গে পড়েছেন, বিষাদিত হয়েছে তার চিত্ত।
জীবনে সকলের সমস্যা এই, একটা দিক রাখতে গেলে, অন্যটি ছাড়তে হয়। অর্থ উপার্জন করতে যে ভয়ানক খাটুনি, তাতে শরীর থাকে না, আবার শরীর রাখতে গেলে অর্থাভাবে না খেয়ে মরতে হয়। শ্রীরামচন্দ্রের সমস্যা- প্রজারঞ্জন করতে গেলে স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করতে হয়, স্ত্রীর প্রতি কর্ত্তব্য করতে গেলে প্রজারঞ্জন হয় না। স্বাধীনতা লাভ করতে গেলে ভারত দ্বিখ-িত করতে হয়, দেশের অখ-তা রাখতে গেলে স্বাধীনতা লাভ হয় না। সর্ব্বত্রই এই দ্বন্দ্ব। কিসে আমাদের কল্যাণ, তা বুঝতে না পেরে জীবন হয় সমস্যাসঙ্কুল এবং বিষাদময়। অর্জ্জুনের রথের সারথি ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ। আমাদের জীবনরথের সারথিও তিনি। তার বাণী শুনতে পাই না আমরা, সংসারের কোলাহলে বধির বলে। সকল মানবের প্রতিনিধি অর্জ্জুন, আমাদের হয়ে শুনেছেন সেই বাণী। গীতার আঠারটি অধ্যায় যেন আঠারটি সিড়ি; বিষাদ হতে মোক্ষে উত্তীর্ণ হবেন, তবেই গীতা-মায়ের শান্তিময় ক্রোড়ে পৌঁছানো যাবে। মৃত্যুর পর মুক্তিলাভ গীতার লক্ষ্য নয়, এই জীবনেই মোক্ষের অবস্থা লাভ, এই আদর্শ। এই জীবনে যিনি মুক্তি পোয়েছেন, পরলোকে তিনি তো মুক্তি পাইবেনই।গীতা-মায়ের যে স্তনধারা আঠার অধ্যায় ধরে বর্ষিত হয়েছে, উহা ‘অদ্বৈত অমৃত’। বিশ্বে সকল বিভেদ বিদ্বেষ দূর করে পরাশান্তি দান করতে সমর্থ। ‘অদ্বৈত’ তত্ত্বের অনুভবই অমৃত। উহা মরণধর্মী জীবকে অমৃতত্ব এবং দুঃখী জীবকে আনন্দের অধিকারী করে। এই তত্ত্বের জ্ঞান না থাকায় আমরা বহু দেখি- লোকজন, হাতিঘোড়া, পশুপাখী ইত্যাদি। সবার মধ্যে যিনি এক ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ রূপে বিরাজিত, তাকে দেখি না, অনুভব করি না। গীতা আঠার অধ্যায়ে এই তত্ত্বে আমাদেরকে পৌঁছে দেন। শাস্ত্র দুঃখমুক্তির জন্য বাসনা কামনা ত্যাগের কথা বলেছে। গীতার উপদেশ তা নয়।সব কামনার মূলে একটি কামনা আছে, ভিত্তি ভূমি আছে। সেই লক্ষ্য জেনে, দৃষ্টি সেদিকে স্থির রেখে চলতে হবে। জীবনে অনেক প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়, তাতে যেন লক্ষ্যহারা না হই। জীবনের লক্ষ্য স্থির হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তা হলে, দুঃখ লাঘব হয়ে যাবে। গীতা প্রকাশ করেছে, সেই লক্ষ্য কি-
যং লব্ধা চাপরলাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ
যস্মিন্ স্তিত্বা ন দুঃখেন গুরণাপি বিচাল্যতে।। ৬/২২
যাকে পেলে জগতের অন্য কিছু লাভ শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয় না। যাকে পেলে গুরুতর দুঃখ এসেও বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে না, সেই শ্রীভগবান লাভই জীবনের লক্ষ্য। সেই আমাদের সাধ্য-বস্তু। তার দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে আমাদের চলতে হবে জীবনপথে।
এই দেহ কেন্দ্র করে যে অহঙ্কার, সেই দেহের উপর কি অধিকার আছে আমাদের? ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া, গাছের একটি পাতাও নড়ে না। বর্ণের আদিতে ‘অ’ এবং অন্তে ‘হ’ বিশ্বের আদিতে ও অন্তে যিনি আছেন ও থাকেন, তারই শুধু হওয়া সাজে ‘অহং’ আর কারও নয়। ‘আমি’, ‘আমার’- এই হতেই আমাদের যত গোলমাল, যত অশান্তি। সব ‘আমিত্ব’, তাকে সমর্পণ করে তার শরণাগত হলেই, কল্যাণ। সৎ কাজও মন্দ হয়ে যায়, যদি সেখানে অহঙ্কার জাগে। তাই শ্রীভগবান্, গীতার শেষ অধ্যায়ে শুনালেন চরম কথা-
সর্ব্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যঃ মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।। ১৮/৬৬
সব ধর্ম্ম ছেড় যদি কেবল আমার শরণ লও, সেজন্য যদি তোমায় পাপ স্পর্শ করে, আমি তোমাকে সকল পাপ হতে মুক্ত করব। সর্বতোভাবে তার হতে হবে, তখন আর কোনো কর্ত্তব্য থাকবে না। তখন, সবই ভগবানের কাজ, তুমি কেবল নিমিত্ত মাত্র।সর্ব্বতোভাবে তার শরণাগতি, ইওয়াই শ্রেষ্ঠ পন্থা। এই শরণাগতি আসলেই পরম কল্যাণ। পায়ের জুতা সেবা করতে পারে তখনই, যখন সে চরণে স্থান পায়। যতক্ষণ অহঙ্কার আছে, ততক্ষণ এই শরণাগতি, জুতার মত অভিমানশূন্যতা, আসে না। শরণাগতি আসলে, তখন আমার কিছু নয়, সবই তার- ‘তোমারি গরবে গরবিনী হাম্, রূপসী তোমার রূপে’। এই বোধে, স্মরণে, উপাসনায়, তার উপর ঐকান্তিক নির্ভরতায় নোমে আসে তার অপার করুণার ধারা। তখন তিনিই সাধকের, ভক্তের সকল ভার গ্রহণ করেন। শ্রীভগবানকে আপন জন, প্রিয় ও সর্বভূতের সুহৃদ বলিয়া যিনি জানেন, তিনিই শান্তিলাভ করেন- গীতায় এই ভগবানের বাণী-
