
শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা
া আশালতা বৈদ্য
রথযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। বৈদিক সমাজে প্রথমে এ জাতীয় কোন উৎসবের প্রচলন ছিল না। স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণির ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা। স¤্রাট অশোক এসবের বিরুদ্ধে অনুশাসনও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোন অনুশাসনই লৌকিক ধর্মের এ প্রবাহকে প্রতিহত করতে পারেনি।
রথযাত্রা হিন্দুদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব। মিলনের এক মহামেলা। বর্ষা ঋতুর আগমনের শুরুতেই এই উৎসব গ্রামে-গঞ্জে নগরে বিপুলভাবে সর্বজনীন রূপ নেয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বর্ষাবিধুর আবহাওয়ার মধ্যেও বহুস্থানে মেলা বসে। বিপুল জনসমাগম ঘটে।সাধারণত, রথযাত্রা বলতে আমরা আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে অনুষ্ঠিত শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাই বুঝি। শ্রী জগন্নাথ আসলে ভগবান বিষ্ণুরই অবতার। অনেকের মতে, শ্রী জগন্নাথের এই মূর্তিরূপ শ্রী ভগবানের অসম্পূর্ণ রূপেরই প্রতিচ্ছবি। কারও কারও মতে, এই অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণ মূর্তি নিরাকার ব্রহ্মারই প্রতিরূপ। এই রথ উৎসব পুরীর শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকেন্দ্রিক উৎসব। শ্রী জগন্নাথ ও বিষ্ণু অভিন্ন। শুধু রূপভেদ মাত্র।
রথযাত্রার উৎস সম্বন্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ নানা কাহিনী প্রচলিত। এর মধ্যে অণ্যতম কাহিনী নিম্নরূপ-
একদিন শ্রীকৃষ্ণ একটি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জরা নামক এক শিকারি ব্যাধ দূর থেকে শ্রীকৃষ্ণের লাল পা দুটি দেখে, লাল পাখি ভ্রমে, তা শরবিদ্ধ করলে শ্রীকৃষ্ণ ডাল থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যান। আহত শ্রীকৃষ্ণকে দেখে জরাব্যাধ হায় হায় রবে চিৎকার করতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এই ঘটনা পূর্ব নির্ধারিত। পূর্বের এক জনমের তাদের উভয়ের কর্মফলের কারণেই, তার (শ্রীকৃষ্ণের) জরাব্যাধের হাতে দেহ ত্যাগের ঘটনা ঘটছে। তথাপি, জরাব্যাধ বারবার অনুশোচনাপূর্বক কৃষ্ণভজনের অনুমতি প্রার্থনা করলে শ্রীকৃষ্ণ জরাব্যাধকে বলেন যে, সে যেন প্রথমে দক্ষিণে গিয়ে পরে পূর্বদিকে সমুদ্র উপকূল ধরে হেঁটে যায়; এভাবে গিয়ে যেখানে সমুদ্রের জলে সে (জরাব্যাধ) তার (শ্রীকৃষ্ণের) চিতার কাঠ ভেসে যেতে দেখবে, সেখানে সেই কাঠ সংগ্রহ ও প্রতিষ্ঠাপূর্বক সে যেন আরাধনার ব্যবস্থা করে। এরপর শ্রীকৃষ্ণ তার লৌকিক দেহ ত্যাগ করেন। অতঃপর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মরদেহ সৎকারের জন্য দ্বারকায় না পাঠিয়ে সমুদ্র উপকূলে দাহ করার মানসে চিতায় উঠিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। জরাব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের আদেশনুসারে সমুদ্র উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরীতে এসে পৌঁছেন। এদিকে জ্বলন্ত চিতায় মরদেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার পূর্বেই সমুদ্রের এক প্রচ- ঢেউয়ের আঘাতে চিতার আগুন নিভে যায়। কিছু দেহাবশেষসহ চিতার কাঠ সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে থাকে। জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ সেই কাঠ সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে সেইগুলো স্থাপনপূর্বক দারুব্রহ্ম বা জগন্নাথরূপে আরাধনা করতে থাকেন। এই জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অনুরোধে বিশ্ববসু তদকর্তৃক সংগৃহীত চিতার কাঠ (শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ) রাজাকে দান করেন। রাজার দেব কারিগর বিশ্বকর্মা সেই কাঠ দ্বারা মূর্তি নির্মাণের ভার গ্রহণ করেন এই শর্তে যে, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। অনেকদিন চলে যায়, বদ্ধ নির্মাণশালা থেকে মূর্তি নির্মাণের সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা ভেঙে নির্মাণশালায় প্রবেশ করেন। মূর্তি নির্মাণে এরূপ অনাকাক্সিক্ষত, বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বাকর্মা মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত (তখন পর্যন্ত মূর্তির হাত-পা-চোখ নির্মিত হয়নি) রেখেই স্থান ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধনির্মিত মূর্তির মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি স্থাপন করে মূর্তিতে চক্ষু, দৃষ্টি এবং প্রাণের সংস্থানপূর্বক তা আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এই মূর্তিগুলো হলো জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তিত রূপই হলো প্রভু জগন্নাথ। রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের কোনো অংশকে অপাঙ্ক্তেয় করলে, অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রাখলে সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে; সমাজ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই সমাজ সামনে এগিয়ে চলে। এককথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। লেখক:ট্রাস্টী,হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট
