পীর বাড়িতে গণহত্যার জন্য সেহরির সময়কেই বেছে নিয়েছিল পাকিরা
বগুড়ার শহরের থেকে মাত্র ৭-৮ মাইল উত্তরে রামশহর গ্রাম। এই গ্রামটির খুব কাছে ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় ও বেহুল-লখিন্দরের বাসর ঘর নামে কথিত পুরাকীর্তির ঐতিহাসিক স্থান। ওই গ্রামেই বাস ছিল উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত এক পীর পরিবারের। যে পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন ডা. কহরউল্লাহ সাহেব। তিনি ছিলেন মোজাদ্দেদিয়া তরিকাপন্থি একজন সুফি সাধক। তিনি শুধু ইসলাম সম্পর্কেই অগাধ জ্ঞান রাখতেন না, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও তার ছিল অবাধ বিচরণ। পীর হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন উদারমনা, আলোকিত মানুষ। তিনি বেশকিছু বইও লিখেছেন। তার মৃত্যুর পর গদিনসীন পীর হিসেবে দায়িত্ব পালন তার আপন ছোট ভাই পীর বেলায়েত হোসেন। বগুড়ার এই পীর পরিবারটি বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মান্ধ, স্বার্থান্বেষী বা সুযোগ সন্ধানীদের মতো ছিল না। তারা বাঙালি জাতির ন্যায় সঙ্গত স্বাধিকারের পক্ষে ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতার পক্ষেই ছিল এই পরিবারটির অবস্থান। এই পরিবারের তিনজন সদস্য সক্রিয়ভাবে রণাঙ্গনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যা থেকেই পাকিস্তানিদের তীব্র আক্রোশ তৈরি হয় এই পীর পরিবারটির প্রতি। স্থানীয় রাজাকাররা তিন সদস্যের যুদ্ধে যোগদান ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানের কথা অনেক আগেই বগুড়ার পাক সেনা ক্যাম্পকে জানিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই মূলত পাক সেনারা এই পীর পরিবারের উপর আঘাত হানার পরিকল্পনা করে। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর রাম শহরের ওই পীর বাড়িতে আক্রমণ চালায় বর্বর পাকিস্তানিরা। সে দিনটা ছিল ২৩তম রমজানের দিন। গ্রামবাসীর সঙ্গে এই পীর পরিবারের সদস্যরাও সেহ্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় পুরো গ্রাম ঘেরাও করে কয়েকজন গ্রামবাসীসহ পীর পরিবারের সাত সদস্যকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে পাক সেনারা। যাদের মধ্যে ছিলেন ৬৮ বছর বয়স্ক পীর বেলায়েত হোসেন এবং সপ্তম শ্রেণির স্কুল পড়–য়া এক কিশোরও। শেষ ইচ্ছা হিসেবে পীর বেলায়েত ফজরের নামাজ পড়তে চেয়েছিলেন। বর্বর পাকিরা সেই সুযোগও দেয়নি এই বুজুর্গ পীরকে। এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে বিখ্যাত এই পীর পরিবারের সাত সদস্যকে। ভয়াবহ এই হত্যাকা- সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম পীর পরিবারের নাতি মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ শোয়েব শাহরিয়ারের (জিন্নাহর) কাছে।
তিনি বলেন, দিনটি ছিল ২৩ রমজান। পারিবারিক জীবনে আমার জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হায়েনারা আমার নানা-মামাসহ সাতজন এবং গ্রামের অন্যান্য চারজনসহ মোট ১১ জনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কোনো মুসলমান যার মধ্যে ন্যূনতম ইমান রয়েছে ইসলামের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে সে কি পবিত্র রোজার মধ্যে সেহরি থেকে ধরে এনে হত্যা করতে পারে? আমার নানা অসুস্থতার কারণে ওই সময় রোজা রাখতে পারছিলেন না, এই অসুস্থ মানুষটিকেও কুত্তারা হত্যা করেছিল। আর ছোট নানার ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সেও ওই জালিমদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ওরা যদি মুসলমান হয়, তাহলে শয়তান কারা? শোয়েব শাহরিয়ার আরও বলেন ‘ধর্মকে শিখন্ডী করে এই শহীদদের আত্মাহূতিকে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত রাখতে আবারও যুদ্ধে যেতে হবে। কারণ আমার পরিবারের পবিত্র আত্মাদের আর কখনো অসম্মানিত হতে দিতে পারি না।’
লেখক: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়