সমবায়ী ক্লাব-সমিতিগুলোকে কার্যকর ও শক্তিশালীকরণে সরকারি নজরদারি সময়ের দাবি
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
সমবায় একটি গণমুখী আন্দোলন। এ আন্দোলন জাতির দর্পণ হিসেবে কাজ করে। যাকে অবলম্বন করে জাতি আত্মনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে কাািক্সক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম। একটি অবহেলিত জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায় এ আন্দোলন। সমাজের অবহেলিত মানুষগণ একজোট হয়ে সততা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে। এসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়েই সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সমবায় একটি আন্দোলন। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার একটি বিশাল ক্ষেত্র। প্রতিটি সমবায় সমিতি এক একটি অর্থনৈতিক ইউনিট। প্রতিটি সমবায় সমিতি জনগণকে সংঘবদ্ধ করার একটি বিশাল অঙ্গন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়Ñ একা একা ভাত খেলে পেট ভরে, কিন্তু পাঁচজনে বসে একত্রে খেলে পেটও ভরে, আনন্দ হয় এবং পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তবে বড় কথা হচ্ছে, সমবায় শুধু অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা হলো আর্থসামাজিক আন্দোলন, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, নব প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার সহায়ক শক্তি। গণমুখী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দারিদ্র্যবিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টিতে অন্যতম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হচ্ছে সমবায়ী উদ্যোগ।
এ দেশ পল্লী প্রধান এবং পল্লীর প্রায় সবায় কৃষক। তারা আর্থিক দিক দিয়ে কেউই সচ্ছল নয়। রোগে ঔষধ জোটে না, শীতে গরম কাপড় পরতে পারেন না, জমিতে যে ফসল হয় তাতে বৎসর চলে না। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের কৃষি প্রধান ক্ষেত্রে এবং কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকতা আসেনি। তাই এদেশ কৃষি প্রধান হয়েও এখানে কৃষি ক্ষেত্রে এখনো আশানুরূপ অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। উন্নয়নশীল বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশেই সমবায়ের নীতিকে গ্রহণ করে আশানুরূপ ফল লাভে সক্ষম হচ্ছে। বাংলাদেশও এ আদর্শে বিশ্বাস হয়ে ঘাটতি পূরণে করে স্বাবলম্বী ও স্বাচ্ছন্দ্যের অধিকার হতে পারে নিঃসন্দেহে। তাছাড়া পশু পালন, গৃহ নির্মাণ, পানি সেচ, মাছের চাষ, মাছ আহরণ, বীমা ব্যবস্থা প্রভৃতি বহু ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য অর্জনে ক্লাব সমিতি বা সমবায়ের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাই আজকাল উৎপাদন সমিতি, ক্রেতা সমিতি, বিক্রয় সমিতি, গৃহ নির্মাণ সমিতি, বীমা সমিতি প্রভৃতি সমবায় আন্দোলনের অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
সারাদেশে সমিতি ও ক্লাবগুলো সংগঠনের নীতিমালা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। নিয়মিত সভার আয়োজন করে মহল্লা ও পাড়ায় মহিলাদেরকে একত্রিত করে সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয়াদিসহ সামাজিক বিভিন্ন কাজ কর্মের ব্যবস্থার আলোচনা পূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। মহিলা সদস্যাগণের সুযোগ্য নেতৃত্বে এবং এলাকাবাসীর প্রগতিশীল জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দিকনির্দেশনা নিয়ে সমিতিতে মহিলাবৃন্দ সমবায়ী চেতনায় গড়ে তুলছে খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, নার্সারি ইত্যাদি। এছাড়াও অনেক সমিতিতে হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তাদের সমিতিতে সেলাই মেশিন ও উলবুনন মেশিনও আছে। এ সমস্ত সমিতিতে সেলাই ও উলবুনন শিক্ষা দিয়ে বেকার মা-বোনদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করা হচ্ছে।
উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করার জন্য সাংগঠনিকভাবে মাঝে মধ্যে ক্লাব/সমিতিগুলোকে টিভি, সেলাই মেশিন, রেডিও, হারমোনিয়াম, ফুটবল, ভলিভল এ জাতীয় সামগ্রী প্রদান করে পুরস্কৃত করা হয় এবং কাজের ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণœ রাখা হয়। পাশাপাশি এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসন থেকেও এ জাতীয় কর্মকা-ের জন্য সদস্যদেরকেও পুরস্কৃত করা হয়। ক্লাব সমিতি ঘরগুলো বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরাও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করে আসছে। এমনকি মাঝে মধ্যে ক্লাব সমিতি কেন্দ্রে জনসভা এবং সরকারি মতবিনিময় সভাগুলোও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কখনো কখনো ক্লাব সমিতি কেন্দ্রগুলোতে চক্ষু শিবির, বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মশালা এবং ত্রাণ কার্যক্রমও পরিচালিত হয়। মাঝে মধ্যে বন্যায় আশ্রয়হীন মানুষদেরকে আশ্রয়ণেরও ব্যবস্থা করা হয়।
দেশের সমবায় সমিতিগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ মহিলা সমবায় সমিতি। এসব সমিতি সব প্রতিকূলতার মাঝে গ্রামীণ জনপদে, কৃষি ও গৃহপালিত পশুদের নিয়ে সমবায় করে, যা অর্থনীতির ভিত্তি বা ম্যাক্রো ইকোনমিক স্থিতিশীলতাকে লালন ও সংরক্ষণ করছে। এসবের কথা ভালোভাবে বলা হয়নি অথবা নারীর ক্ষমতায়নে এসব সমবায় সমিতির অবদানকে আদৌ মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। সমবায় সমিতিগুলোকে অর্থনীতির অঙ্গনে অর্থবহভাবে বিচরণ করার সুযোগ দিতে হবে। আগামীতে এসডিজি আসছে অর্থাৎ টেকসই অর্থনীতির (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং) লক্ষ্য অর্জনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনীতিবিষয়ক কমিশন ইতোমধ্যেই ১০টি লক্ষ্য অর্জনের কথাও ঘোষণা করেছে। এতে অবদান রাখতে হলে সমবায় সমিতিগুলোকে অবশ্যই প্রণোদনা দিতে হবে এবং সরকারকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে জরুরিভাবে।
ইদানিংকালে বিভিন্ন ক্লাব সমিতির কার্যক্রমে বেশ অনেকটাই ভাটা পরিলক্ষিত হয়েছে। ক্লাব সমিতিগুলোর সুষ্ঠু সুন্দর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুস্থ নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে পরিচর্যামূলক ব্রত গ্রহণ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। সামাজিক, রাজনৈতিক যেকোনো সংগঠনকেই হোক না কেন তাকে জোরদার করার জন্য ক্লাব সমিতি একটি উৎকৃষ্ট মাধ্যম, সেজন্য আমাদের সকলকে সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান হয়ে ক্লাব/সমিতিগুলোকে কল্যাণমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। ক্লাব সমিতিগুলো যত বেশি কল্যাণমুখী হবে সংগঠনের ভাবমূর্তিও তত বৃদ্ধি পাবে। তাই সংগঠনকে বাঁচাতে হলে আমাদের ক্লাব সমিতিগুলোকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপরে অবশ্যই দাঁড় করাতে হবে। এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই সহযোগী মনোভাব নিয়ে ক্লাব সমিতিগুলোর কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই ধরনের ক্লাব সমিতিগুলোকে সারা দেশব্যাপী সম্প্রসারণের জন্য সর্বস্তরের জনসাধারণকে নিঃস্বার্থ কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। তাহলেই জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের বুকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারব।
লেখক: উপ-মহাপরিচালক, আনসার ও ভিডিপি (পিআরএল), আনসার-ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান