বিশ্বজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বালুর খনি
কামরুল আহসান : আক্ষরিক অর্থেই আমাদের এ সভ্যতা গড়ে উঠেছে বালু দিয়ে। বালুর ব্যবহার নতুন নয়। সেই প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা থেকেই বালুর ব্যবহার হচ্ছে। বালু না থাকলে পিরামিড নির্মাণ সম্ভব হতো না। যদিও পিরামিড নির্মিত হয়েছে বড় বড় পাথর দিয়ে। কিন্তু, ধারণা করা হয় সেই পিরামিডগুলো সাজানো হয়েছে প্রথমে বালুর পাহাড়ে, তারপর বালুগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সে যাই হোক, আমাদের বর্তামন সভ্যতা তো বালু ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই বস্তুটি অপ্রতুল। চারদিকে ছড়ানো। কিন্তু, ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, পানি ও তেলের চেয়ে এটি আমাদের প্রধানতম সম্পদ। বালু ছাড়া একটি বিল্ডিংও কি কল্পনা করা যায়। এই যে সারাবিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার লাখ লাখ কারখানা গড়ে উঠেছে বালু ছাড়া কি তা সম্ভব হতো? যেখানেই ইমারত নির্মাণের প্রশ্ন সেখানেই বালুর উপস্থিতি অনিবার্য। কিন্তু, বালুর যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রকৃতি কেমন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে মানুষ তা খেয়ালও করেনি। তেল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের ব্যবহারে যে প্রকৃতির ক্ষতি হচ্ছে মানুষ তা জানে। কিন্তু, একবারে চোখের সামনে বালুর যাচ্ছেতাই ব্যবহার আমাদের কতোখানি ক্ষতি করছে সত্যি করে বলতে আমরা দীর্ঘদিন তা খেয়াল করিনি।
আমরা দেখেছি বালু তো আছেই, চোখের সামনে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বালু। বালু আছে সমুদ্রের তীরে, বাবলুর আছে নদীর গভীরে, আর সীমাহীন বালু আছে আদিগন্ত ছড়ানো মরুভূমি জুড়ে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, মরুভূমির বালু ইমারত নির্মাণে ব্যবহার করা যায় না। কারণ তাতে জল ধরে না। অর্থাৎ সেই বালুতে বাতাসের উপস্থিতি যতো বেশি ততো পরিমাণ জলের উপস্থিতি নেই। সিমেন্টের সাথে তা ভালো করে জোট বাঁধে না। তাই সৌদি আরবকে বালু কিনতে হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। সব সমুদ্রের বালুও ব্যবহার করা যায় না। প্রথমত তার গুণগত মানের অভাবে। দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। ২০০৫ সালের পর ইন্দোনেশিয়ায় দুটে দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে ডুবে গেছে তার আশপাশ থেকে বালু তোলার কারণে। তাই যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ সমুদ্র থেকে বালু তোলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তা ছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন নি¤œাঞ্চলের অনেক দেশের সমুদ্রতীর থেকে বালু উত্তলন করা যায় না। বালু উত্তলন করে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীন। কারণ গত দশকগুলোতে চীনে প্রচুর পরিমাণ দালানকোঠা ও কলকারখানা গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র তা করেছিল গত শতাব্দীতে। এখনো মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ বালু ব্যবহার করতে হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন বালু লাগে। তাহলে বছরে কী পরিমাণ বালু লাগে সেই হিসাবটা সত্যিই বিস্ময়কর। এই বিশাল পরিমাণ বালু যখন একবার ভূপৃষ্ঠ থেকে উঠে আসে তাহলে অনিবার্যভাবেই সে স্থানে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। যা আর কোনোভাবেই পরিপূর্ণ সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির মাঝে একটা ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আমাদের পৃথিবী হয়তো একদিন এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ পরিকল্পনাহীন বালু উত্তলনের কারণে একদিন একদিক থেকে ভূপৃষ্ঠ নদী বা সমুদ্রের অতলে দেবে যেতে থাকবে। সৃষ্টি হবে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে মরক্কোতে অর্ধেক বালুই উত্তলন করা হয় অবৈধ উপায়ে। তাতে সরকারের কোনো নজর নেই। বালু উত্তলন এখন প্রায় এক মাফিয়া চক্রের মতো বিভিন্ন দেশেই বিরাজ করছে। নদীর বালু সবচেয়ে বেশি চাহিদাসমৃদ্ধ। কিন্তু, পরিকল্পনাহীন তা উত্তোলন করে সমগ্র পৃথিবীকেই ঠেলে হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। আজ যেমন তেলের জন্য যুদ্ধ হচ্ছে একদিন হয়তো পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ হবে বালুর জন্য। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হবে বালু। উইকিপিডিয়া, গার্ডিয়ান, ওয়ার্ড বিজনেস