সুশাসন-ন্যায়বিচারের অভাবেই দেশে জঙ্গি কার্যক্রম
মে. (অব.) সারোয়ার হোসেন
সুশাসন ও ন্যায়বিচারের অভাবেই দেশে জঙ্গি কার্যক্রমের মতো ঘটনা ঘটছে। ন্যায়বিচারের অভাবে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আর নিরপরাধীরা শাস্তিভোগ করে। ফলে ক্রমান্বয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আর দেশে বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি মোটেই ভাল নয়। হলি আর্টিজেন হামলার পরে নিরাপত্তার নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করছে তাতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তার ধারণাটা হলো মানুষের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক রেখে নিরাপত্তাব্যবস্থা বজায় রাখা। কিন্তু এ হামলার পর মানুষের জীবনযাত্রাকে পুলিশি অ্যাকশনের কারণে একটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে মানুষের জীবনযাত্রাকে ন্যূনতম ব্যাঘাত ঘটানো যায়। কিন্তু গুলশানে জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিরাপত্তাব্যবস্থা কতখানি উন্নতি হয়েছে তাতে সন্দেহ আছে। একটি দেশে এ রকম অনিরাপদ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কেন? এটা মূলত হয়ে থাকে যখন দেশে জনভিত্তির উপর সরকার পরিচালিত না হয়। জনগণের কাছে যদি সরকারের জবাবদিহি থাকে এবং দেশে যদি সঠিক বা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন জনগণ কী চায় সরকার সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু এ সরকার তো জনভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত। অন্যদিকে এই মেন্ডেটবিহীন সরকার যে নিরাপত্তা ইস্যু থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সে জায়গাতে এড্রেস করা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আর সে জায়গা হলো সুশাসন ও ন্যায়বিচার। যে সমাজে ন্যায়বিচার ও সুশাসন থাকে, সেখানে জনগণের মাধ্যমে নিরাপত্তা বজায় থাকে। এখানে জনগণ নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে কম অংশগ্রহণ করছে। যার ফলে সার্বিকভাবে বাস্তবক্ষেত্রে নিরাপত্তা ততটা আসছে বলে মনে হয় না। হলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারাদেশে বিভিন্ন অভিযান পরিচালিত করেছে। তবে সার্বিকভাবে অনেকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে এ ধরনের অভিযান অনেকটা পাতানো। অনেক পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের সন্তানকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর পরিচয়ে অনেক আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে। পরে তাদেরকে জঙ্গি সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবার অনেক জঙ্গিকে ক্রসফায়ারে মারা হয়েছে। এসব হত্যাকা-ের মাধ্যমে আসলে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট সোর্সকে নষ্ট করা হচ্ছে। সুইসাইড বোমা বা আত্মঘাতী হামলার বিষয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর এইসব অভিযান বা কার্যক্রমকে অনেকটা পাতানো বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদকে পুঁজি করে সরকার বেনিফিট নিতে চাচ্ছে বলে আমি মনে করি। নিরাপত্তা পরিস্থিতি সে অর্থে উন্নতি হয়েছে বলে মনে করি না। বর্তমানে দেশে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে তাতে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জনস্বার্থে নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। যাতে করে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুমের তালিকা ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছে। একটা দেশে যদি এ ধরনের গুমের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহলে সেদেশে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি হতে পারে না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ স্বাধীনতার এত বছর পরে কেন দেশে গুমের মতো ঘটনা মিডিয়াতে বের হবে? কেন ক্রসফায়ার করা হবে? বিনাবিচারে কেন মানুষকে মরতে হবে? আসলে এসব কার্যক্রম সরকারকে কোনো একটা এজেন্সি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে যদি নিরাপত্তাব্যবস্থা বজায় রাখতে হয়, তাহলে তা জনগণকে সম্পৃক্ত করেই করতে হবে। তারপর নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বজায় রাখতে হবে। তখন দেখা যাবে সত্যিকার অর্থে যারা অপরাধী, জনগণই একসময় তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবে। আর দুর্ভাগ্য হলো পুলিশের ভাষ্য দেশের কম মানুষই এখন বিশ্বাস করে। পুলিশ সম্পর্কে জনগণ আজকে যে মনোভাব পোষণ করছে তাতে সেদেশে কখনওই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যবস্থার উন্নতি হতে পারে না।
পরিচিতি : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ : বায়েজিদ হোসাইন