বাংলাদেশ-ইসলায়েল কূটনীতি মোদির সফরের প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়বে না
আনোয়ারুল করিম : প্রতিবেশি দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েল সফরে যাচ্ছেন। প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির এ সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে। বাংলাদেশের বন্ধু দেশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইসরায়েল সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে? দৈনিক আমাদের অর্থনীতির এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কূটনীতিকরা বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির ইসরায়েল সফরের কোনো প্রভাব বাংলাদেশ-ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্কে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল শু
ক্রবার দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে
আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, এর কারণ আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবির পক্ষে আমাদের সুদৃঢ় অবস্থান। কিন্তু ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তা একান্তভাবেই ভারতের ব্যাপার। দীপু মনি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শুধু ভারত নয়, বহু আরব রাষ্ট্রেরই ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কে কোনো প্রভাব নেই। ঠিক একইভাবে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সুসম্পর্ক হলেও বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব নেই, পড়বেও না। দীপু মনি আরও বলেন, সবসময় বলা হয়, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হলে আপনি রাশিয়ার বন্ধু হতে পারবেন না, আবার আপনি ভারতের বন্ধু হলে চীনের বন্ধু হতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশ কিন্তু প্রমাণ করেছে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল সুর- সবার সঙ্গে
বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরীতা নয়, তা কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রহিসেবে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। কাজেই, ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এম তৌহিদুর রহমান গতকাল শুক্রবার দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। শুধু নরেন্দ্র মোদির আমলেই নয়, বরং কংগ্রেসের আমলেও ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল। তখন তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না, তখনও নয়াদিল্লিতে ইসরায়েলের কনস্যুলার অফিস ছিল। ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক মূলত কারিগরি সহযোগিতাই বেশি। ভারতের কোচি ও নাগাল্যান্ডে এক সময় ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন; যদিও তারা পরবর্তীতে ইসরায়েলে নাগরিকত্ব নিয়ে চলে যায়। তৌহিদুর রহমান বলেন, নরেন্দ্র মোদি প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসরায়েল সফরে গেলেও এর প্রভাব বাংলাদেশ-ইসরায়েল সম্পর্কে পড়ার সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের স্বাধীন সত্ত্বায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তখনই হবে, যখন ইসরায়েল স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে।
জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গতকাল শুক্রবার দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, ভারত ও ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের ধারা এবং বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের
ধারা ভিন্ন। ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের গত প্রায় বিশ বছর ধরে চলমান কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে পনের বছরের যে সম্পর্ক তা মূলক কারিগরি সহযোগিতার সম্পর্ক। এম হুমায়ুন কবির বলেন, বর্তমান নরেন্দ্র মোদির আমলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক সক্রিয় হলেও তা বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কিন্তু এখন আরব দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে; আরব বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক থাকলেও তা বাংলাদেশের কাছে কোনো প্রভাব যেমন ফেলছে না। তেমনি প্রতিবেশি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে নরেন্দ্র মোদির ইসরায়েল সফরের প্রভাবও ইসরায়েল-বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না।
প্রসঙ্গত, আগামী ৪ জুলাই প্রথমবারের মতো কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েল যাচ্ছেন। মোদির সফরকে ঘিরে সেজে উঠছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে মোদি বন্দনা। সেখানকার এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘তৈরি হও: বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রধানমন্ত্রী আসছেন আমাদের দেশে’। মোদির এ সফরে দুই দেশের মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমঝোতার বৃদ্ধি ঘটবে বলে আশাবাদী ইসরায়েল।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যেটি ইসরায়েলের সঙ্গে সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যদিও উভয়ই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র। তবে ২০১৪ সালের এক জরিপে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, কোনও ধরনের কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকা সত্বেও ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২৫৭৭ ডলার মূল্যমানের পণ্যসামগ্রী ইসরায়েলে রপ্তানি করা হয়। এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলে আগেও রপ্তানি হয়েছে: ইসরায়েলে গত ২০১৪ সালেই প্রথমবারের মতো পণ্য রপ্তানি হয়েছে, এমন নয়। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ইসরায়েলে ২২ হাজার ৪৩৫ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় আট হাজার ৩৬৪ ডলারের পণ্য। ২০১০-১১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৩০ হাজার ৫৪৫ ডলারের পণ্য। আর এর আগের অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৬১ ডলার। প্রসঙ্গত, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে মূলত বিভিন্ন ধরনের পোশাকই ইসরায়েলে রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শার্ট, টি-শার্ট, জার্সি এবং ট্রাওজার্স। এর বাইরে অল্প কিছু সিরামিক পণ্যও ইসরায়েলে রপ্তানি হয়েছে।