মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিক আটক দালালের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় আতঙ্কে অবৈধ বাংলাদেশিরা
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া থেকে : মালয়েশিয়ায় ৫১ জন অবৈধ শ্রমিককে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। ৩০ জুন মাঝ রাতে কুয়ালালামপুরের পেটালিং জায়া ডরমিটরিতে ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর জেনারেল দাতুকে সেরী মুস্তাফার আলীর নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে অবৈধ শ্রমিকদের আটক করা হয়েছে। অভিযানের সময় ২৩৯ জনের কাগজপত্র যাচাই বাছাইয়ের পর ৫১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশি। এ অভিযানে অবৈধ অভিবাসীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অভিযানের পর ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী সাংবাদিকদের বলেন, বেশিরভাগ শ্রমিক আসবাবপত্র-প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানাগুলোতে কাজ করছেন। মুস্তাফার আলী বলেন, আমরা দেশের স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে এ অভিযান চালিয়েছি।
তিনি বলেন, “ই-কার্ড (প্রযোজ্য কার্ড) নিবন্ধনের তারিখ ৩০ জুন শেষ।” পারমিট ছাড়া কর্মরত শ্রমিকদের ধরতে এখন থেকে প্রতিদিনই এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মুস্তাফার আরও বলেন যে, সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, নিয়োগকারী ও বিদেশি শ্রমিককে বৈধতা নিতে ইমিগ্রেশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এই বিষয়ে ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা করেছে। গ্রেফতারকৃত মিয়ানমারের একজন নারী কর্মী বলেন যে, তিনি নির্দিষ্ট সময়সীমা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তিনি বলেন, তার নিয়োগকর্তা তাকে এ বিষয়ে বলেননি। এদিকে দি মাস্টার বিল্ডার্স এসোসিয়েশন মালয়েশিয়া (এম বি এ এম) সরকারের নিকট ই-কার্ড করার সময় ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছে। এসোসিয়েশন বলেছে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান এবং ধীরগতি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে সহজ ও দ্রুত ই-কার্ড করতে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টকে সহযোগিতা করবে। তারা আশা করে ই-কার্ড করার প্রক্রিয়া সহজ করা হলে নিয়োগকর্তারা অবৈধ কর্মীদের ই-কার্ড করতে উদ্বুদ্ধ করবে। উল্লেখ্য, ই-কার্ড করার ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাকে কর্মীদের নিয়ে ইমিগ্রেশনে যেতে হয় তখন কোম্পানির আয় ব্যয় সহ যাবতীয় তথ্য দিতে হয়। এছাড়া ইমিগ্রেশনের ধীরগতির কারণে নিয়োগকর্তারা ই-কার্ড করতে উৎসাহী হয়নি। বরং দীর্ঘদিনের কর্মী নিয়োগে এজেন্ট বা মিডলম্যান পদ্ধতি অনুসরণ করে এজেন্টের দ্বারস্থ হয়েছে। ফলে এজেন্টরা ই-কার্ড করার জন্য অর্থ আদায় করেছে। অনেক কর্মীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তারা ই-কার্ড করার জন্য ৫শ থেকে ১ হাজার রিঙ্গিত দিয়েছে। অথচ মালয়েশিয়া সরকার ই-কার্ড ফ্রি দিচ্ছে।
ই-কার্ড মালয়েশিয়া বৈধভাবে কাজ করার সরকারি স্বীকৃতির একটি প্রক্রিয়া। যাদের পাসপোর্ট নাই তাদের জন্য এ স্বীকৃতি। এটি করার পর অবশ্যই পাসপোর্ট করতে হবে এবং রিহায়ারিং কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা মিডলম্যানদের দৌড়াত্ম্যে প্রক্রিয়াটিতে আশানুরুপ সফলতা আসেনি। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ এ ঘোষণা করার পর সর্বশেষ ২৬.৯৫৭ নিয়োগকর্তার মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ অবৈধ কর্মী ই-কার্ডের জন্য আবেদন করলে শেষ সময় পর্যন্ত ১,৪০,৭৪৬ জনের ই-কার্ড করেছে যা লক্ষ্যমাত্রার ২৩ ভাগ। ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট ৬ লক্ষ ই-কার্ড করার আশা করেছিল। লক্ষ্য পূরণে ১ জুলাই থেকে নিয়োগকর্তা ও অবৈধ কর্মীদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদানের কাজ শুরু করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। কিন্তু এমবিএএম এর মতো নিয়োগকারী কর্মী সংকটে ভুগা প্রতিষ্ঠানগুলো সময় বৃদ্ধির জন্য সরকারের নিকট আপিল করেছে। সকলে তাকিয়ে আছে কি হয়।
উল্লেখ্য, এ সুবিধা নিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের বরাবরের মতো বিভিন্নভাবে অনুরোধ ও প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছিল মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ মিশনের হাইকমিশনার মুহ: শহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধে মালয়েশিয়ান সরকার এই সুযোগটি দেন দেশটিতে বসবাসকারী কাগজপত্রহীন কর্মীদের বৈধ হওয়ার জন্য।
তিনি জানান, বৈধ কাগজপত্র পেতে মাইইজি’র অধীনে চলমান রিহায়ারিং প্রকল্পে ১ লাখ ৮৮ হাজার বাংলাদেশি রেজিস্ট্রেশন করেছেন। আর অন্য সকল দেশ মিলিয়ে করেছে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার। ‘যারা মেডিকেল আনফিট, যাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা চলমান রয়েছে এবং যে সকল কর্মী বৈধভাবে কোনো কর্মক্ষেত্রে কর্মরত ছিলেন কিন্তু তারা মালিকপক্ষকে অবহিত না করে পালিয়ে গেছেন। অফিস তার বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশনে অভিযোগ দাখিল করেছে’ এই তিন শ্রেণির কর্মীরা ই-র্কাড করতে পারবে না। ই-কার্ডের আওতায় আসতে বাংলাদেশিদের বার বার জোরালো আহবান জানিয়েছি। আমরা সকলকে সচেতন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় দূতাবাসের কন্সুলার টিম পাঠিয়েছি। ই-র্কাডধারীরা দ্রুত পাসপোর্ট করাতে পারবেন বলেও জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার বলেছিলেন, আগে স্বাভাবিকভাবে পাসপোর্ট আসলেও এখন থেকে আমরা ডিএইচএল’র মাধ্যমে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত পাসপোর্ট নিয়ে আসা হচ্ছে এবং তা দ্রুত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
হাইকমিশনের বাইরে দালালের উৎপাত কমাতে করণীয় সম্পর্কে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা একটি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলছি হাইকমিশনের অভ্যন্তরে কিংবা আশপাশে একটি বুথ করার ব্যাপারে। আশা করি আগামী কয়েকমাসের মধ্যে এ সকল সমস্যার সমাধান হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কমিউনিটি নেতা বলেন, মালয়েশিয়া সরকার প্রবাসী অবৈধ কর্মীদের বৈধতা লাভে বার বার সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু অবৈধ বাংলাদেশিরা দালালের উপর নির্ভরশীল। ই-কার্ড নিবন্ধন করতেও শত শত অবৈধ বাংলাদেশি প্রতারণার শিকার হয়েছে। ই-কার্ড নিবন্ধন করে দেয়ার কথা বলে দালাল চক্র প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে ৫শ থেকে ১ হাজার রিংগিত হাতিয়ে নিয়ে ই-কার্ড না করে প্রতারণা করেছে। তিনি ই-কার্ড নিবন্ধন কার্যক্রমের সময় সূচি আরো ৬ মাস বর্ধিত করণের লক্ষ্যে মালয়েশিয়া সরকারের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহ আলম হাওলাদার বলেন, মালয়েশিয়ায় ই-কার্ড নিবন্ধনের বাইরে থেকে যাওয়া হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশির বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে ই-র্কাডের নিবন্ধনের সময় বর্ধিতকরণে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেল মো. সায়েদুল ইসলাম জানান, ই-কার্ড করার সময় ৩০ জুন শেষ হয়েছে। কিন্তু রিহায়ারিং চালু আছে। যাদের পাসপোর্ট নেই তাদের জন্য ই-কার্ড দেয়া হচ্ছিল। এই কাজ যাতে বৃদ্ধি করা হয় এজন্য এমপ্লয়াররা সরকারের কাছে আপিল করেছে। আমরা আশা করছি অবৈধ কর্মীরা আবারো ই-কার্ড করার সুযোগ পাবে। মালয়েশিয়া সরকার যে সহজ সুযোগ দিয়েছিল তা অব্যাহত রাখা হলে কর্মীরা উপকৃত হবে।