এভারেস্ট জয় নিয়ে সন্দেহের জবাব দিলেন মুসা ইব্রাহীম
আনোয়ারুল করিম : ২০১০ সালের ২৩ মে দেশের জন্য অসামান্য এক গৌরব বয়ে আনেন মুসা ইব্রাহীম। সেদিন গোটা দেশ উৎসব করেছিল। কিন্তু সেই অর্জনের রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় এভারেস্ট বিজয় নিয়ে বিতর্ক। মুসা ইব্রাহীম নিজে এই বিতর্কে নিশ্চুপই থেকেছেন। তবে সম্প্রতি এই বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়েছে।
মুসা ইব্রাহীম সাত মহাদেশের সর্বোচ্চ সাত পর্বতশৃঙ্গ অভিযানের অংশ হিসেবে ওশেনিয়া অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কারস্টেনজ পিরামিড অভিযানে গিয়ে বিপদে পড়েন। কারস্টেনজ পর্বত জয় করে ফেরার পথে বৈরি আবহাওয়ার কারণে বেইজ ক্যাম্পে আটকা পড়েন তিনি। পরে হেলিকপ্টার গিয়ে মুসা ইব্রাহীমকে উদ্ধার করে। এ অভিযানের বিষয়ে পত্রপত্রিকায় মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে খবর প্রকাশ এবং সোস্যাল মিডিয়ার নতুন করে বিতর্ক দেখা দেয়। রোববার নিজের ফেসবুকে ‘এভারেস্ট ও বাংলা চ্যানেল : কেন আমি চুপ থাকি?’ শিরোনামে দীর্ঘ লেখনীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সঙ্গে মুসা ইব্রাহীম তুলে ধরেছেন এভারেস্ট বিজয়, বাংলা চ্যানেল পাড়িসহ যাবতীয় অর্জনের প্রমাণ।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে মুসা ইব্রাহীম বলেছেন, ‘নষ্ট চোখে নীল আকাশে ওড়া পাখিটাকেও ময়লা মনে হয়। সুতরাং ফেসবুকে সবার মন্তব্য দেখে যেটা বুঝলাম, বক্তব্যগুলো এমন: আমি এভারেস্টে যাইনি, বাংলা চ্যানেলও পাড়ি দিইনি। কিংবা দিলেও পুরো পথ নৌকায় পাড়ি দিয়ে পাড়ের কাছাকাছি এসে ক্যামেরা দেখে সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে কিছুটা সাঁতরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছি, যাক বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দিয়েছি।’ মানুষ কতখানি নিচে নামতে পারে, সেটা বলার মধ্যে আমি কোনো কৃতিত্ব খুঁজে পাই না।
মুসা ইব্রাহীম তার দীর্ঘ জবাবে এসব সন্দেহের জন্য প্রথমত অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন ইনাম আল হকের দিকে। প্রয়াত পর্বতারোহী সজল খালেদের প্রতি ইনাম আল হকের অবহেলার অভিযোগও করেন মুসা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে সজলকে ২০১৩ সালে ইনাম আল হক তথা তার ক্লাব বিএমটিসি কোনো আর্থিক সহায়তা করেনি। অথচ সজলের মৃত্যুর পর তার নামেই অর্থ সংগ্রহ করে এই ক্লাবের সদস্যরা নেপালে পর্বতারোহণে গেছেন, সজলের নামে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নেপালে স্থাপন করার নাম করে। এসব নানা বিষয়ের কারণে বিএমটিসি পরিত্যাগ করে সে বছরই নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চান, তাহলে অনুগ্রহ করে এমএ মুহিতকে সঙ্গে আনবেন। কারণ চুলু ওয়েস্ট পর্বত জয় না করেই সনদ নেওয়ার কৃতিত্ব যে দুজনের, তার মধ্যে সজল খালেদ এখন প্রয়াত।
মুসা বলেছেন, ইনাম আল হক, সজল খালেদ, তারেক অনুদের আরও নিচে নামাটা শুরু হয়েছিল, ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানো আর ৫টা ১৬ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর পর। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ। তবে আমি এভারেস্ট চূড়া জয় করে বেস ক্যাম্পে নেমে আসার পরপরই এক সাংবাদিক ফোনে বললেন, মুসা আপনি কি সার্টিফিকেট পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এই প্রশ্ন? উত্তরে সেই সাংবাদিক বলেছিলেন, ঢাকায় সজল খালেদসহ বেশ কয়েকজন একটা ‘চেইন ইমেইল’-এ আপনার এভারেস্ট জয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আর বলেছে, আপনি এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট না পেলে সেটাকে ‘অফিসিয়াল’ বলে মানা নাকি সম্ভব নয়। শুনে মনটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের দেশের কতিপয় ব্যক্তি তখন উঠে-পড়ে লেগেছিলেন প্রমাণ করতে যে, ‘এভারেস্ট জয়টা মুসা ইব্রাহীমের দাবি। ব্যাটা আদৌ এভারেস্টে যায়নি, গিয়েছিল চট্টগ্রামের পাহাড়ে’। এই বলার চলটা শুরু করে গিয়েছিলেন প্রয়াত সজল খালেদ। এই গোষ্ঠীÑ যার শিরোমনি ইনাম আল হক, সহযোগী সজল খালেদ, তারেক অনু, এমএ মুহিত, মীর শামছুল আলম বাবু, শাহজাহান মৃধা বেনু প্রমুখÑ শুরু করেছিল প্রচারণা। আর সচলায়তনের কতিপয় ব্লগার শুরু করেছিলেন অনলাইনে ব্লগিংÑ নেভারেস্ট। সেই ঘৃণ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি তারা নিজেরাই করেছিলেন, যখন অনেকেই আমার এভারেস্টের ছবি সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপের ফটো ফরেনসিক ল্যাব থেকে ফরেনসিক টেস্ট করিয়ে আনলেন এবং বললেন যে, কোনো ছবিতে একটা পিক্সেলেরও হেরফের করা হয়নি, সব মেটাডেটা ঠিক আছেÑ তখন এই ন্যক্কারজনক ব্লগিং থেমেছিল। ফেসবুক যুগের আগে ব্লগ ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। সেখানেই তখন আলোচনা হয়েছিল। আমার ছবি মিথ্যা প্রমাণ করতে না পেরে অনেকেই পিছু হটেছিলেন। আচ্ছা যারা তখন আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিলেন তারা কি কেউ ক্ষমা চেয়েছিলেন?
কাঠমুন্ডুভিত্তিক হিমালয়ান ডেটাবেস সেন্টারে নেপাল হিমালয়ের সাত হাজার মিটারের চেয়ে উঁচু পর্বত জয়ের রেকর্ডগুলো সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে ১৯০৫ সাল থেকে। বিশ্বব্যাপী এই তালিকা পর্বতারোহীদের কাছে বাইবেল হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে। হিমালয়ান ডাটাবেজে আমার ও আমার সহযাত্রীদের নাম স্পষ্টাকারে লেখা আছে। আমি বলতে চাই, সবার এভারেস্ট জয়ের ছবি নিরীক্ষা নিয়ে সমান দাবি উঠুক। কষ্ঠিপাথরে যাচাই হয়ে আসুক নির্ভেজাল সত্য। কথাটা বলার কারণ আমার বন্ধু ও সহযোগী পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্তের এভারেস্ট জয়ের ছবি জালিয়াত করে ভারতের এক পুলিশ দম্পতি গত বছর ধরা খেয়েছেন। এই ঘটনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
সর্বশেষ কার্সটেন্জ পিরামিড অভিযান নিয়ে মুসা ইব্রাহীম বলেছেন, ব্যাপারটা কি এমন যে, আপনারা একটা লাশ চেয়েছিলেন? কারো মৃত্যু আপনারা কামনা করেছিলেন? ব্যাপারটা যদি সেটাই হয়ে থাকে, তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি, আমরা মনুষ্যত্ব বিবর্জিত জীবনসত্ত্বার একেবারে কিনারে এসে পৌঁছেছি। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী