পলাশী ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা এবং একটি পর্যবেক্ষণ
পলাশী এক রক্তাক্ত ইতিহাস। পলাশী পরাধীনতার ইতিহাস, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। পলাশী মুক্তিসংগ্রামীদের পরাজয়ের ইতিহাস, ট্রাজেডি ও বেদনাময় এক শোক স্মৃতির ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে যুদ্ধের নামে মীর জাফর আর জগৎশেঠদের মতো কিছু ক্ষমতালিপ্সু, স্বার্থান্বেষীর চরম বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলা। যাতে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। ইংরেজ ও তার এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রথম পলাশী দিবস উদযাপিত হয় কলকাতায়। সঙ্গে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মওলানা আকরম খাঁ।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, পলাশীর ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রায়দুর্লভ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগম, রাজা রাজবল্লভ, নন্দকুমারসহ কিছু সংখ্যক ধূর্ত কৌশলী চক্র। ওইদিন মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ পুরো উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়, অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। পরাজয় ও নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী, মুক্তি সংগামের প্রথম সিপাহসালার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন ও প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরীকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। জাতীয় বীর সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ করে অনুপ্রাণিত হয়, ব্যথিত হয়। একথা সত্য, নবাব সিরাজ ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর, দেশপ্রেমিক। চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে তার করুণ পরিণতি ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাসে, বিশেষ করে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি মোড় পরিবর্তনকারী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। মূলত পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ই ইউরোপীয়দের হটিয়ে ভারতে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের পথ তৈরি করে দেয়। পলাশীর যুদ্ধে জয়ের খবরে লন্ডনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। কারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারছিলেন বাংলার সম্পদে কোম্পানিটি এখন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের সেবাদাসদের সাহায্যে এভাবেই বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন, শোষণ চালায়। কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পলাশীর যুদ্ধের ফল ভিন্ন হলে ইংল্যান্ড নয় বাংলাই বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে পারত। পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পর ইংরেজরা সাম্রাজ্য বিস্তারের চিন্তা করেনি। যে কদিন ক্ষমতার দাপট আছে, সে কদিন যা পাওয়া যায়, তা লুটেপুটে নিয়ে নিজেদের অর্থ ও বিত্তের ভা-ার পরিপূর্ণ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে কায়েম হয় লুটপাটের একচেটিয়া রাজত্ব। টাকা আদায়ের জন্য দেওয়ানি হাতে নিয়ে ক্লাইভ চালু করেন দ্বৈত শাসন। তার এই শাসনের ৫ বছরের মধ্যেই শুরু হয় বাংলাজুড়ে প্রচ- দুর্ভিক্ষ।
১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই বছরই সুজাউদ্দিন খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন লাভ করেন। এই ধারাবাহিকতায় নবাব আলীবর্দী খাঁর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি মৃত্যুর পূর্বেই তার কনিষ্ঠ কন্যার পুত্র সিরাজুদ্দৌলাকে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার পরবর্তী নবাব মনোনীত করে যান। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। শৈশব থেকেই সিরাজউদ্দৌলা অত্যন্ত সুদর্শন, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। আলিবর্দি তাকে খুব বেশি আদর করতেন এবং সবসময় সঙ্গে রাখতে চাইতেন। এজন্য সিরাজের দুই খালা তার প্রতি ভীষণ ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং সবসময় তার অমঙ্গল কামনা করতেন। রাজনীতিতে তার খালা, বিশেষ করে ঘষেটি বেগমের প্রভাব ছিল। ইংরেজদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ স্থাপন করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করেন।
এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক যে মীরজাফর, তা আঁচ করতে পেরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র কুরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে পুনর্বহাল করেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়; তারা পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে ‘যুদ্ধ’ বলতে নারাজ। তাদের মতে, এটা ছিল যুদ্ধের প্রহসন। পলাশীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও লর্ড ক্লাইভের মধ্যে এক যুদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়। যেখানে নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণই করেনি। আগেই সন্ধি হয়েছিল, যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হলে বাংলার নবাব হবেন মীর জাফর। পবিত্র কুরআন শরিফ ছুঁয়ে তিনি শপথ করেছিলেন, এই যুদ্ধে তার দলবল নিয়ে তিনি নিষ্ক্রিয় থাকবেন। হয়েও ছিল তা-ই। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল।
পলাশী বিপর্যয়ের পর শোষিত বঞ্চিত শ্রেণি একদিনের জন্যও স্বাধীনতা সংগ্রাম বন্ধ রাখেনি। ফকির বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লাকেন্দ্রিক আন্দোলন, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ইত্যাদির মাধ্যমে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ বারবার তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। ফলে দীর্ঘ দুইশ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রামের পর ব্রিটিশরা লেজ গুটাতে বাধ্য হয়। পরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক/সম্পাদনা: আশিক রহমান