কৃষিতে বিপ্লব : বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ, শেখ হাসিনার বাস্তবায়ন
স্বাধীনতার আগে এবং পরে সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা ৬০ ভাগ খাদ্য উৎপাদন হতো দেশে। বাকিটা আমদানি করতে হতো বাইরে থেকে। বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি মানুষের সম্পূর্ণ খাদ্য চাহিদা মেটানো হচ্ছে দেশের উৎপাদন থেকেই। এ থেকে বোঝা যায়, কৃষি খাতের উন্নতি কতখানি ব্যাপক। আর এ উন্নতি কোনো জাদুকরি কারণে ঘটেনি। এর পেছনে ছিল সঠিক পরিকল্পনা ও কৃষকের বিপুল শ্রম।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ৬০ থেকে ৭০ দশকে অধিকাংশ কৃষিজমি একফসলি ছিল। অনেক জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকত। স্বাধীনতার পর এর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিখাতের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নির্দেশ দিয়েছিলেন কোনো জমিই যেন অব্যবহৃত না থাকে। এমনকি সরকারি জমিও যেন আবাদ করা হয়। এ নির্দেশনা জনগণের মাঝে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোতেও খালি জায়গায় সেনাসদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে ধান চাষ শুরু করেন। ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি, গুলশানসহ অন্যান্য এলাকার বাড়ির সামনে ছোট ছোট খালি জায়গাগুলোয়ও বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করা শুরু হয়।
কৃষিখাতে তখন বেশকিছু সহায়ক কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটাই ছিল বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিখাতে বিপুল মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সরকার থেকে কৃষক পর্যন্ত সব পর্যায়ে উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। এর প্রভাব পড়ে বিপুলভাবে। কৃষিখাত নিয়ে এরই ধারাবাহিকতায় অনাবাদি জমিতে ফসল চাষ বৃদ্ধি পায়। তারপর শুরু হলো একফসলি জমিকে দ্বিফসলি জমিতে রূপান্তর করা। একইসঙ্গে অধিক ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। শস্য বৈচিত্র্যও বাড়তে থাকে। সরকার নিয়োজিত মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কৃষকদের উপদেশ ও নির্দেশনা দান করতেন। সরকারি প্রণোদনা পেয়ে কৃষকরা উৎসাহিত বোধ করেন।
কৃষি বিপ্লবের আরও একটি বড় উপাদান সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সার কারখানাগুলো প্রচুর পরিমাণে সার উৎপাদন করছে। তবে সার ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে সরকারের ভর্তুকি নীতি। একসময় যে সার ৬০ টাকা দরে বিক্রি হতো ভর্তুকির ফলে তার দাম দাঁড়িয়েছিল কমবেশি ২০ টাকা। ভর্তুকির এ ব্যবস্থাটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারই প্রবর্তন করেছে। এমনকি সেচ পাম্প চালানোর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছিল। বোরো মৌসুমে অনেক সময় শহরে লোডশেডিং বাড়িয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার হিসেব মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এক দশক আগেও বাংলাদেশের আলু উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন ৮২ লাখ ১০ হাজার টন। এ সাফল্য বাংলাদেশকে করেছে আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম।
কৃষি বিপ্লবের আরেকটি উপাদান উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা বিশেষ অবদান রেখেছেন। সরকারি সহায়তা নিয়ে তারা গবেষণার মাধ্যমে নতুন ধরনের বীজ উদ্ভাবন করেছেন। এসব বীজ দেশের মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্পসময়ে ফসল তোলা নিশ্চিত করে।
এ সাফল্য ধরে রাখতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পাশপাশি আরও একটি কথা না বললেই নয়, যে কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়িয়েছেন, তারা তাদের উৎপাদিত শস্যের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। প্রতি মৌসুমেই ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষকের মধ্যে হাহাকার ওঠে। সরকার কৃষি খাতের প্রণোদনা ও কৃষকের কল্যাণে অনেক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এখন ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ভূমিকা গ্রহণ জরুরি।
লেখক : কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ