অবৈধই থাকল ষোড়শ সংশোধনী : বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে না সংসদ
এস এম নূর মোহাম্মদ : বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
এদিকে এ রায়ের ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের ক্ষমতা থাকল না। গতকাল ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই রায় ঘোষণা করা হয়েছে বলে আদালত উল্লেখ করেন। আদালত বলেন, আমরা কিছু ফাইন্ডিংস দিব এবং হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয় বাদ দেওয়া হবে। গতকাল সোমবার মামলাটি রায়ের জন্য আপিল বিভাগের কার্য তালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়। সে অনুযায়ী সকাল ৯টায় আদালত বসার পর প্রথমেই এই রায় হওয়ার কথা ছিল। তবে বিচারপতিরা এজলাসে আসেন সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে। যদিও গুরুত্বপূর্ণ এ রায় শোনার জন্য সকাল ৯টার আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মী আদালতে উপস্থিত হন। এজলাসে বিচারপতিরা প্রবেশ করলে তাদেরকে বেশ গম্ভীর মনে হয়। এজলাসে বসে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বাই আনঅ্যানিমাস ডিসিশন দ্য আপিল ইজ ডিসমিসড’।
এর আগে সংবিধান প্রণয়নের সময় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা প্রথমে সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। এদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনেন। এতে বিচারপতিদের অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির জন্য গঠন করা হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল। তবে জিয়াউর রহমানের আনা সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। যদিও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। যাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সংসদকে। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ওই বছরের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। বৃহত্তর বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। যার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় গত বছরের ১১ আগস্ট।
সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে হাইকোর্ট বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্মাবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। চলতি বছরের ৭ মার্চ আপিল বিভাগ শুনানির জন্য জ্যেষ্ঠ ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দেন। ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্রপক্ষ, অ্যামিকাস কিউরি ও রিট আবেদনকারীদের বক্তব্য শোনেন আদালত। শুনানি শেষ হয় গত ১ জুন। পরে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করার জন্য অপেক্ষমান রাখেন আদালত। শুনানিতে সহায়তার জন্য আদালত ১২ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে ১০ জন তাদের মতামত উপস্থাপন করেন।
অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে শুধুমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনী রাখার পক্ষে মত দেন। আর সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া, এম আই ফারুকী, ফিদা এম কামাল এবং এ জে মোহাম্মদ আলী। এর বাইরে আদালতের অনুমতি নিয়ে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য মতিন খসরু। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে বক্তব্য রাখেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। আর রিট আবেদনকারী পক্ষে বক্তব্য দেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সম্পাদনা : গিয়াস উদ্দিন আহমেদ