‘ফরহাদ মজহার’ ড্রামা-শেষ? না শুরু?
ফরহাদ মজহার ইস্যুটা সুপারহিট হতে হতেও হলো না। জাস্ট আর দুটো দিন যদি এই কাহিনী টানত, দারুণ জমজমাট এক গল্পের সূত্রপাত হতো। অনলাইনে তো বটেই, অফলাইনেও তোলপাড় শুরু হয়ে যেত। ব্যাড লাক। দারুণ এক শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার থেকে বঞ্চিত হলাম। স্টিল, বার চৌদ্দ ঘণ্টা অনলাইনে যা হলো, খুব খারাপ হয়নি। অন্তত খবরটা প্রকাশিত হওয়ার পর, প্রথম কয়েক ঘণ্টা তো ছিল অসাম।
প্রথম খবরটা প্রকাশ করেন জনৈক বিএনপিপন্থি ফেসবুকার। কিছুটা সময় গেল, অপহরণ না নিখোঁজ, এই সন্দেহে। এক গ্রুপ নিঃসন্দেহ হয়ে গেলেন, এটা অপহরণ। কারণ র্যানসমের ডিমান্ড এসেছে। অন্যপক্ষ এখনো সন্দিহান, অপহরণ? না নাটক। নাটক মানে, ফরহাদ সাহেবের লেখা নাটক। সন্দেহের কারণ র্যানসমের অ্যামাউন্ট, মাত্র পঁয়ত্রিশ লাখ? অন্যদিকে ‘এটা অপহরণ না, গুম’ এই তত্ত্ব নিয়েও অনেকে হাজির হলেন। বলাই বাহুল্য, এরা অ্যান্টি সরকার পার্টি। আর বাঙালি যেহেতু তার সব আক্টিভিজম ফলায় ফেসবুকে, তাই ফেসবুক খোলার পর থেকে নিউজফিড ভাসছে এদেশীয় শার্লক হোমসদের গোয়েন্দাগিরিতে।
ফরহাদ সাহেবের সমর্থক কিংবা পক্ষের গ্রুপটা মোটা দাগে অ্যান্টি আওয়ামী। আর সেই অর্থে অ্যান্টি শাহবাগীও বলা যায়। এই গ্রুপে সোকল্ড মুক্তমনারাও আছেন। ইন অ্যা নাট শেল, অ-সরকারি ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপের পুরোটাই এই দলে। ইনারা পড়েছেন সমস্যায়। ধিক্কার জানাবেন? না খুশি জানাবেন? আনন্দ জানানো সমস্যা, কারণ সুশীল হওয়ার ব্যাকরণে তা নিষিদ্ধ। চক্ষুলজ্জা খুলে ডাস্টবিনে ফেলা লাগবে। ব্যাপারটা উদাহরণ হয়েও থাকবে। আবার উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানালে, সমস্যা হচ্ছে তাদেরকে বিএনপিপন্থি মনে হবে। সো, তারা কম্প্রোমাইজ ফর্মুলায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ‘যেকোনো মানুষের গুমেই যেহেতু প্রতিবাদ করা ফরজ, তাই তার সুস্থ প্রত্যাবর্তন কামনা করছেন’।
তবে এর আগে দুকলম বয়ান দিয়েছেন। ‘এই লোকটি বিশেষ সুবিধার না’Ñ অর্থাৎ আমাকে বিএনপি ভাবিয়া ভুল করবেন না। এরপরে যথারীতি মুখস্থ বুলি, ‘আমার সাথে ভিন্নমত থাকলেও আমি তার সুস্থ প্রত্যাবর্তন চাই।’ এটা অনেকটা নাস্তিক হত্যা পরবর্তী নন-নাস্তিক বাহিনীর স্টেটমেন্টের মিরর ইমেজ, ‘এই হত্যা আমি সমর্থন করি না, বাট উনি এসব ধর্ম বিদ্বেষী কথা লিখে ভালো কাজ করেননি।’ Ñহত্যার প্রতিবাদ করায় আমাকে আবার নাস্তিক ভাইবেন না। পার্থক্য হচ্ছে, এবার বক্তা স্বয়ং নাস্তিকবাদী, এই যা। মানসিকতার দিক দিয়ে কমবেশি সবাই এক গোয়ালেরই গরু। নট ব্যাড।
আর ফরহাদ সাহেবের পক্ষের গ্রুপ? যথারীতি উনার সুস্থ প্রত্যাবর্তন চাচ্ছেন, তবে তার আগে ফরহাদ বন্দনা। তার অ্যান্টি সরকার অবস্থানের প্রশস্তি। উনাদের কেউ কেউ আবার প্রথমেই শর্ত দিয়ে দিলেন, ‘বাট, কিন্তু, তবে’ ছাড়া ধিক্কার জানাতে। নাস্তিক মৃত্যুর পরে আগে যেমনটা করতেন নাস্তিকবাদি গ্রুপ। কী কী হতে পারে, তার সম্ভাব্য বয়ান আসতে থাকল। একদিন আগে যেহেতু অ্যান্টি ভারত বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাই সন্দেহের তীর ভারতের দিকেও ঘোরানো হলো। পুরনো গুম, খুনের বৃত্তান্ত আসতে লাগল। ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে সালাহউদ্দিন। এরপরে কী হতে পারে, তার সম্ভাব্য সম্ভাবনা নিয়ে কমবেশি সবাই দুকলম লিখলেন। পরোক্ষে সবাই দোষ চাপালেন সরকারের ঘাড়ে।
এরপরে? আমার হতাশা এখানেই। কাহিনী যখন মার্কেটে এলো, তখন আর কলাম পাঠাবার টাইম নাই। পত্রিকা প্রেসে চলে গেছে। আর এমন কাহিনী গরম থাকতে থাকতে ব্যবহার না করলে, পরে কপালে শিকে ছেড়ে না, পাবলিক পড়ে না। এই টপিকটায় অনেক সুযোগ ছিল। যখন কলামে খানিক গোয়েন্দাগিরি ফলাব ফলাব ভাবছি, ঠিক এমন সময়ে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল। হোয়াট অ্যা ব্যাড লাক।
সরকারি বয়ান এখন পর্যন্ত যা এসেছে এবং ফেসবুক বাহিনী যেসব কাহিনী ফাঁদছে, তাতে কেউই ঘটনার জট খুলতে পারেননি। প্রতি মুহূর্তে তথ্য আসছে, কাহিনীতে এখনো যদিও যথেষ্ট রহস্য আছে, তারপরও কোনো তত্ত্ব হাজির করা ঠিক হবে না। এখন স্পেকুলেট করা বেজায় রিস্কি, সুশীল হিসেবে বাজারে দাম কমে যাবে। যারা ইতোমধ্যে তত্ত্ব হাজির করে ফেলেছেন, দুপক্ষেরই, তাদের এখন প্রেস্টিজ ইস্যু। ফরহাদ সাহেবের বর্ণনাটা দারুণ যুক্তিসঙ্গত না হলে উনার খবর আছে। আর সরকারের বয়ানে তালবাহানা টাইপ কিছু থাকলে, ফরহাদ সাহেবের হিরো হওয়া আটকায় কে? হি উইল রক। সো, কাহিনী এখন দারুণ এক মোড়ে অবস্থান করছে।
যাই হোক, আপাতত নতুন কিছু তথ্য আসার আগে পর্যন্ত কমবেশি সবাই ‘পোস্ট রিকভারি’ স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন। একগ্রুপ জানাচ্ছে, ফেসবুকে সকলের এমন সোচ্চার হওয়ার কারণেই, অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে ব্যাপারটার সঙ্গে সরকারকে জড়িত করছে, ‘… তাই সরকার বাধ্য হয়েছে তাকে ছেড়ে দিতে’। কেউ আছে পুলিশ, র্যাব এদের প্রশংসায়, ‘এরা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই।’ আর এক গ্রুপ শুরু করে দিয়েছেন গোয়েন্দাগিরি, ‘কেন গিয়েছিলেন খুলনা?’ ‘কেন বেরিয়েছিলেন রাত ৩টার সময়?’
ফরহাদ সাহেব ফেরত আসায় আপাতত ক্যাজুয়ালিটির সম্ভাবনা শূন্য, তবে কাহিনীর জট খোলা জরুরি। সত্যিই অপহরণ হয়ে থাকলে নেহাত আইনশৃঙ্খলা কেস। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। তবে তা না হলে, কাহানী ইজ ডেঞ্জারাস। সরকার গুম করার ধান্ধা নিয়েছিল, এমনটা বিশ্বাস করা বেজায় কষ্টকর। বিভিন্ন গুম বা ক্রসফায়ার সরকার করায়নি, এমনটা হলফ করে কেউ বলতে পারবে না। তারপরও, এমন একজন প্রমিনেন্ট ব্যক্তিত্বকে গুমের ঝতকি সরকারের নেওয়ার কথা না, স্পেশালি যখন সবকিছু সরকারের আয়ত্তে। আবার ঘটনাটা ফরহাদ সাহেবের নাটক, এমনটা বিশ্বাস করাও কষ্টকর। অন্তত তার মতো বুদ্ধিমানের কাছ থেকে এত সস্তা নাটক প্রত্যাশিত না। তাহলে? অন্য কেউ ইনভলভড? আর তেমনটা হলে, টার্গেট তো আল্টিমেটলি সরকার। দেখা যাক, এদেশের প্রফেশনাল এবং অনলাইন গোয়েন্দারা কী এন্ডিং এনে হাজির করেন।
এর মাঝে ছোট খাট যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে আছে গাজীপুরের বয়লার বিস্ফোরণ। ১০ জনের মৃত্যু। তেমন বড় কিছু না। মজদুর শ্রেণির মৃত্যু, তাও আবার মাত্র ১০। সো, নট অ্যা নিউজ অ্যাট অল। উল্টো রথযাত্রা প্রথমে বন্ধ, পরে আবার খুলে দেওয়া। এটা অবশ্য খবর, তবে ফরহাদ সাহেবের ব্যাপারটা না হলে ঘটনাটা নিয়ে আরও কিছু লেখালেখি হতো। ইস্যুটা মাঠে মারা গেল আর কি।
কিছু কিছু শার্লক হোমস সন্দেহ করছেন, এই ঘটনা সরকারের ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে, অ্যাটেনশান ডাইভার্ট করা। পেছনে বড় কোনো খেলা হচ্ছে। তবে কী সেই খেলা, তা নিয়ে তেমন কোনো তত্ত্ব তাদের কাছে নেই। তাই এই গল্পটাও পাবলিক খুব ভালো খায়নি। তবে আগামী কিছুদিনে নতুন কোনো কাহিনী যে আসবে না, তাও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। সো, উই ক্যান কিপ গেসিং।
তাহলে সারাংশ কী দাঁড়াল? বহুল প্রত্যাশিত হাই ভোল্টেজ ড্রামার আপাত দুর্বল এন্ডিং? না বড় কোনো গল্পের শুরু? লেটস বাই সাম পপকর্ন অ্যান্ড ওয়াচ দ্য শো।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট