‘ফরহাদ মজহার ডিলেমা’-অপহরণ? না বেড়াতে বেরনো?
ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? তিনি অপহৃত হয়েছিলেন? না নাটক সাজিয়েছিলেন? এই প্রশ্নে ফেসবুক এই মুহূর্তে বেশ ভালোভাবে দ্বিধাবিভক্ত। ফরহাদপন্থি কিংবা ফরহাদ সিম্প্যাথাইজার আর অ্যান্টি ফরহাদ গ্রুপ এই প্রশ্নে বেশ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চলছে গালাগালি, চলছে চরিত্র হনন। ওদিকে আবার চিকিৎসকরা তাঁকে কথা বলতে বারণ করেছেন, ফলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই মুহূর্তে বেজায় ঘোলাটে। কেউই হলফ করে বলতে পারছে না, ‘হোয়াট রিয়েলি হ্যাপেন্ড দ্যাট ডে।’
টুকরো টুকরো যেসব তথ্য আসছে, সেখানেও রয়েছে বেশ গরমিল। পুলিশ ইতোমধ্যে তাদের বক্তব্য পাল্টেছে, জানিয়েছেন আগের সব কথা বাদ। এদিকে ফরহাদ সাহেব এবং তাঁর পরিবারের তরফ থেকে যে দুএকটা কথা বলা হয়েছে, সেখানেও কিছু জায়গায় প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে। তিনি যখন বাসায় ফোন করেছিলেন, সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন বন্দি, হাত বাঁধা, চোখে কাপড়। তাহলে কীভাবে ফোন করলেন? অপহরণকারী ফোন করে ফোনটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দেয়, এমনটা বললে হয়তো প্রশ্নটা উঠত না। এনিওয়ে, প্রশ্ন আরও গজাচ্ছে। ৭টার দিকে ছাড়া পাওয়ার পরে কেন তিনি পরিবারের কাউকে ফোন করেননি। যেহেতু এসবের উত্তর কেবলমাত্র তিনিই দিতে পারেন আর এই মুহূর্তে তিনি কথা বলছেন না, তাই গুজবের পারদ প্রতি মুহূর্তে চড়ছে।
ফেসবুকীয় গোয়েন্দা দুতরফেই আছে। তারা নিয়মিত এমন হাজারো প্রশ্নও যেমন তৈরি করছেন, তেমনি হাজারো উত্তরও এখন ভাসছে ফেসবুকে। কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ছেন পুলিশের প্রতি। কেউ ফরহাদ সাহেবের প্রতি। উত্তরও আসছে এসব গোয়েন্দা কাম আক্টিভিস্টদের থেকে। যদিও সবকিছু অনুমান নির্ভর, তারপরও খেলা চলছে এবং পাবলিকও বেশ মজা নিয়ে খেলছে। ওদিকে ব্লগও কম যায় না। সেখানেও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। টক শো আর কলামেরও অন্যতম টপিক এই মুহূর্তে ফরহাদ সাহেব। যারা তাঁকে বেজায় অপছন্দ করেন তাঁরাও, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, এই বিতর্কে নেমে পড়ছেন। ফলাফল? হি ইজ নাও টক অব দ্য টাউন।
বিতর্কে মজার একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে, আর তা হচ্ছে শিরোনাম বা ঘটনার বর্ণনায় কী বলা হবে। অপহরণ? না নাটক? এক গ্রুপ এই ঘটনাকে অপহরণ বলতেই রাজি না। তাঁদের মতে এটা সাজানো। উনি নিজেকে আলোচনায় আনতে এই নাটক করেছেন। অন্যপক্ষ এই ঘটনাকে অপহরণই বলতে চান। কে করেছে কিংবা পেছনে কে আছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকলেও এটা যে অপহরণ, এই অবস্থানে তাঁরা অটল। স্বপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি নিয়ে তাঁরা দুজনই অনলাইনে ফাইট দিচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে পাঠক কিংবা দর্শক পড়েছে বিপাকে। কোনদিকে যাবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও ঝেড়ে কাশছে না, বা পুরো ইনভেস্টিগেশান শেষ না হওয়ায় কাশতে পারছে না। আর অন্যদিকে ফরহাদ সাহেবের ওপর চিকিৎসকীয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় আগামী কিছুদিন তিনি কথা বলবেন না বলেই মনে হচ্ছে। ফলে, এই মুহূর্তে গুজবের উপর দিয়েই চলছে পুরো মিডিয়া ট্রায়াল। নিত্য নতুন তত্ত্ব এসে হাজির হচ্ছে। স্ত্রীর সাথে বচসা থেকে শুরু করে ‘র’ সংশ্লিষ্টতা। রাতে রিং রোডে কয়টি ওষুধের দোকান খোলা থাকে থেকে শুরু করে গ্রিল হাউজের খাবারের মেনু। বাসে মাত্র তিনজন যাত্রী থেকে শুরু করে ব্যাগ রহস্য। আসছে মাইক্রোবাস থেকে ফরেনসিক এভিডেন্স নেওয়া না নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন। একের পর এক ধাঁধা যুক্ত হচ্ছে আর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হচ্ছে।
আলোচনার আবার বেশ কিছু ডালপালা গজিয়েছে। একটি শাখা এগিয়ে গেছে হুমায়ুন কবির হত্যার দিকে। তিনি খুন হওয়ার আগে, সেই রাতে ফরহাদ সাহেব নাকি তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আহমেদ ছফা সাহেবও তাঁর ডায়েরিতে এমন কিছু কথা লিখেছিলেন যে কারণে সন্দেহের তীর ফরহাদ সাহেবের দিকে যায়। এদিকে হুমায়ুন সাহেবের কন্যা ফেসবুকে জানান দিয়েছেন যে তাঁর পিতার মৃত্যুর সাথে ফরহাদ সাহেবের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে ওখানে তৈরি হয়েছে এক ধুম্রজাল, কে সত্যি বলছেন?
এছাড়াও, তাঁর লুঙ্গি পরিধান, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন, তাঁর কবি প্রতিভা থেকে শুরু করে তাঁর সাম্প্রতিক হেফাজত সখ্য, সব কিছু নিয়েই চলছে বিশ্লেষণ। মৃদু একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, ‘এই ব্যাটাকে শায়েস্তা করাই উচিত।’ কেউ বলছেন, ‘নিজেকে আলোচনায় আনতে অপহরণ নাটক করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব না, ব্যাটাকে দুই ডলা দিলেই আসল খবর বের হবে’। কলাম আসছে, সঙ্গে আসছে ফেসবুক পোস্ট কিংবা ব্লগ। বলাই বাহুল্য, পক্ষ অনুযায়ী তাঁরা বক্তব্য সাজাচ্ছেন। ওদিকে বয়সের কারণেই হোক আর সরকারবিরোধী অবস্থানের কারণেই হোক, বিভিন্নভাবে একথা বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, ‘উনার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখান উচিত।’ উনার কিছু হলে বা উনাকে ভিক্টিম প্রমাণ করা গেলে, লাভ উনারই। ফলে উনার সাথে কী আচরণ করা উচিত, তা নিয়েও তৈরি হয়ে গেছে দুটি মত।
কাজটা ভালো হচ্ছে না খারাপ হচ্ছে এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটি বিষয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই, তা হচ্ছেÑ পুরো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লাভবান কে হচ্ছে? আর উত্তরটা হচ্ছে, ফরহাদ মজহার সাহেব। ঘটনাটা তিনিই ঘটিয়ে থাকুন আর যে-ই ঘটিয়ে থাকুক, এই মুহূর্তে ঘটনার পুরো লাভ যাচ্ছে তাঁর ঘরে। সিম্প্যাথি বলুন আর সাধারণ জনতার গুম বিরোধী একটা অবস্থানের কারণেই বলুন, পাবলিক ঘটনার পেছনের ঘটনা জানতে চায়। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেহেতু জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কোনো দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই হাওয়া আপাতত ফরহাদপন্থি গ্রুপের পক্ষেই বইছে।
পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়, তা জানতে সম্ভবত সবাই বেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ফরহাদ সাহেব যেদিন মুখ খুলবেন, সেদিন কি কাহিনীতে নতুন মোড় আসবে? পুলিশ কি এর মধ্যে নতুন কোনো তথ্য-উপাত্ত হাজির করবে? অপহরণকারী কিংবা সেই মাইক্রোবাস থেকে নতুন কোনো তথ্য আসবে? ফোন কল রেকর্ড কিংবা অন্য কোনো ফরেনসিক এভিডেন্স কি নতুন কোনো তথ্যের জোগান দেবে? প্রশ্নগুলো সম্ভবত সবার মনেই ঘুরছে। ক্ষণে ক্ষণে তাই সকলে বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন কিংবা স্টার ফেসবুকারদের স্ট্যাটাস চেক করছেন।
মোদ্দা কথা, কমবেশি সবাই অপেক্ষা করে আছে, কাহিনী জানার জন্য। কী শিরোনাম হয় তা জানার জন্য। এটা অপহরণ? না বেড়াতে বেরনো। নিজের তৈরি নাটক? না সরকারের কিংবা অন্য কারও তৈরি নাটক? পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যদিও ফরহাদ সাহেবের ফেভারে, তবে তা ঘুরে যেতে সময় নেবে না। যদি কোনোভাবে আবিষ্কৃত হয় কাহিনী তাঁর নিজের সৃষ্ট তবে ঝড়ের গতিতে অবস্থার পরিবর্তন হবে। আর যদি দেখা যায় অন্য কেউ কিংবা সরকার, তবে সেখানেও তৈরি হবে নতুন জটিলতা। মজার ব্যাপার হবে, কিছুই যদি না হয়। সাম্প্রতিক অতীতে পুরনো কিছু অপহরণ এবং উদ্ধার ঘটনায় যেহেতু এমনটা ঘটেছে, তাই একটা ধোঁয়াটে সমাপ্তির সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পুলিশের কাছ থেকে অচিরেই তেমন কোনো তথ্য না এলে আর ফরহাদ সাহেব ঝেড়ে না কাশলে, ধরে নিতে হবে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে কংক্রিট কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। আর সেক্ষেত্রে তখন শুরু হবে গেসিং গেম। অনলাইন যুক্ত হবে গোয়েন্দাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা, ‘ব্লেম গেম’ তখন তুঙ্গে উঠবে। যদিও খেলাটা এখনো চলছে, তবে তা তখন হয়ে উঠবে লাগামহীন। কল্পনার চরম সীমায় বসবাস করবে ফেসবুক।
কী মনে হচ্ছে? সমাপ্তিটা কেমন হবে? আসল খবর জানা যাবে? কেস সলভড হবে? ইতিহাসকে আমি বেশ শ্রদ্ধা করি। আর তাই আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কাহিনীর কোনো নির্দিষ্ট সমাপ্তি আসবে না। একটা গোলমেলে, উইন উইন টাইপ ফিনিশিংয়ের দিকে কাহিনী এগুচ্ছে। পুলিশও সম্ভবত কোনো অপহরণকারীকে ধরতে পারবে না। আবার তিনি নিজেই এই কা- ঘটিয়েছেন এমনটাও প্রমাণ করতে পারবে না। আর ফরহাদ সাহেব ‘কিছু মনে নেই’ টাইপ বক্তব্য নিয়ে হাজির হলে তো আর কথাই নেই, কাহিনীর সলিল সমাধি। কিংবা সবাই নিজ নিজ গোয়েন্দাগিরি অবস্থানে অটল থেকে, ফেসবুক আর ব্লগে নিজের বিদ্যা ফলিয়ে যাবে। আর ফরহাদ সাহেবকে নিয়ে তৈরি ডিলেমা থেকেই যাবে। ‘অপহরণ’ না ‘ঘুরতে বেড়ানো’ এই প্রশ্নের উত্তর আর কোনোদিন পাওয়া হবে না।