যৌতুকের অভিশাপ : এক রুচির দুর্ভিক্ষ
ফাহমিদা হক
আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিত্ত, বিত্ত সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে সত্যি কিন্তু যৌতুকের অভিশাপ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি সমাজ। যৌতুককে সামাজিক অপরাধ হিসেবে এতদিনেও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। নারী নির্যাতনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব সবাই এর সাথে জড়িত। নতুন নতুন বিকৃতিও এর সাথে যুক্ত হচ্ছে। সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারেও যৌতুকের কারণে প্রায়ই চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনা শিরোনাম হচ্ছে গণমাধ্যমে। যৌতুকের কারণে কখনো স্বামী, কখনো স্বামীর পরিবারের লোকজন মিলে পিটিয়ে, গলাটিপে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করছে নববধূকে। একজন নারীÑ যে মা, যে শাশুড়ী, সেও ছেলের বউকে হত্যার জন্য ছেলের হাতে কেরোসিন ও দিয়াশলাই তুলে দিয়ে পরিবারের সবার সামনে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখে আনন্দ পেতে পারে; এরপরেও বলতে হবে আমাদের শিক্ষা, রুচি আদর্শের উন্নতি হয়েছে?
যৌতুকজনিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অনেক গৃহবধূ। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মানসিক যন্ত্রণার শিকার ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা একটা মেয়েকে চিরতরে শেষ করে দেয়। আমাদের দেশে কত যে নারীর এই নীরব চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ যৌতুক তা বলে শেষ করার মতো নয়। আমরা মিডিয়ায় বা যেকোনোভাবে যতটুকু দেখতে পাই তা আসল সংখ্যার খুবই ক্ষুদ্র অংশমাত্র। যৌতুকের কারণে কোনো ঘটনা যখন কেলেঙ্কারি পর্যায়ে চলে যায়, কেবল তখনই আমরা শুনতে বা দেখতে পাই। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এত বেশি যে, যৌতুকের কারণে আজকাল যা ঘটছে তা যেন সবার কাছে স্বাভাবিক ঘটনার অংশ মাত্র। ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে ১৯২ জন গৃহবধূকে হত্যা করা হয়। একই কারণে আত্মহত্যা করেন ১৮ জন। ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয় ১১৬ জনকে আর আত্মহত্যা করেন ৯ জন। একই সালে নির্যাতনের শিকার হন ৩১৯ জন। এর বাইরেও নির্যাতনের অনেক ঘটনা রয়েছে যা কোনোদিন প্রকাশিতও হয় না। যৌতুকের বিরুদ্ধে দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও এর সঠিকভাবে প্রয়োগ না হবার কারণে এ ধরনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সমাজের স্তরে স্তরে এর বিস্তার বেড়ে এখন ভিন্ন রূপে নব নব কৌশলে দৃশ্যমান হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে মেয়ের বাবার কাছে যৌতুক চাইতে নেই তাতে ঠকতে হবে । না চাইলে বেশি পাওয়া যাবে।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে যৌতুকের সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। নারীর প্রতি যে সহিংসতা তার ৯৫ ভাগই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে হয়ে থাকে। গত ছয় মাসে ৩৫১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, ২২৬ জন নারীকে হত্যা করা হয় এবং তার মধ্যে ১০০ জনকেই ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই ভয়াবহ অবস্থার কারণ যৌতুক নিরোধ আইন, পারিবারিক সুরক্ষা আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হচ্ছে না।
সর্বশেষে একটা কথা আমাদের সবাইকে মাথায় রাখতে হবে, অনাদর, অবহেলার মাঝে থেকে ভাল কিছুর জন্ম কখনো হতে পারে না, হবার নয়। তাই শিক্ষা, যোগ্যতা আর দক্ষতার মাপকাঠিতে নিজের ছেলে আর মেয়ের বেলায় যেন হয় সমানে সমান। ঘরের ছেলেকে যোগ্য হাতিয়ার আর মেয়েকে সাঁজের পুতুল বানানোর মধ্যে অহংকারের কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে নারী জীবনের যে সবদিক সম্পর্কে যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, স্বাস্থ্য, প্রজনন, বৈবাহিক অবস্থা সকল বিষয়ে নারীর অবস্থান নির্ধারণ জরুরি; সেক্ষেত্রে নারী সে যেই হোক, মেয়ে, বউ, মা, বোন, শাশুড়ি কিংবা ছেলের বউ।
লেখক: পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান