২০৪১ সালে উন্নত দেশের মর্যাদা পেতে হলে
বাংলাদেশ ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, বর্তমান ধারা বেগবান হলে আরও এগিয়ে যাবে। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ভুয়সী প্রশংসা করছে এবং বাংলাদেশকে এশিয়ার ’ইমার্জিং টাইগার’ নামেও অভিহিত করছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বাংলাদেশকে নতুন এশিয়ান টাইগার হিসেবে বিবেচনা করে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছে। বিশ্ববাসী অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের দিকে, আর দেশটিকে দেখছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে, সরকার স্বপ্ন দেখছে, বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তখন থেকেই যখন তিনি ৮ বছর আগে অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রায় বিধ্বস্ত একটি দেশের হাল ধরেছেন। তিনি শুধু নিজে স্বপ্ন দেখছেন না, তিনি সকলকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও দেখাচ্ছেন। সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি বহুমুখী সঙ্কটের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ এখন নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশের স্বাপ্নিক মানুষরা এখন ২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে ৬ শতাংশের উপর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। মাথাপিছু আয় ১৬০০ ডলারে উন্নীত। মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘরে আবদ্ধ। কৃষিতে অর্জিত হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স আয় এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সামাজিক ও মানবউন্নয়ন সূচকে। প্রাথমিকে শিশু ভর্তির হার পঁচানব্বই শতাংশের উপর উঠেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতা অনেক আগেই অর্জিত হয়েছে। অভাবিত উন্নয়ন ঘটেছে প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সত্যিকারের এক ডিজিটাল বাংলাদেশ।
তবে এত কিছুর পরও অতি-আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করতে হলে এসব চ্যালেঞ্জ সাহস ও চৌকষ স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে ৯% থেকে ১০%-এ উন্নীত করতেই হবে যদি আমরা এদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চাই। তার জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো (অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা, বিশেষত এনার্জি ও পাওয়ারে) এবং নি¤œ উৎপাদনশীলতার সমস্যাগুলো দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া। গ্রামের জনগণকে উন্নয়নের প্রক্রিয়ার ধারা থেকে দূরে রেখে কখনো উচ্চ প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না। এছাড়াও, উন্নয়নমূলক পলিসিগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন/রিডিজাইন করতে হবে যাতে আয়-বৈষম্য সম্পূর্ণ দূরীভূত না হলেও বহুলাংশে কমে আসে এবং শিক্ষিত তরুণরা সমান সুযোগ-সুবিধা পায়।
দারিদ্র্যের হার কমেছে কিন্তু দারিদ্র্য নেই এ কথা বলা যাবে না। এখনো ৯.৯৫% লোক হতদরিদ্র এবং জনসংখ্যার ২৪.৩ শতাংশের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাই দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে একাধারে পলিসি ইন্টারভেনশন যেমন দরকার তেমনি খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়নও প্রয়োজন। ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে না পারলে একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির সৃষ্টি হবে এবং ফলে উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে দেশ ছিটকে পড়বে। আর টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি।
যদিও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি উন্নয়নের একমাত্র নির্দেশক নয়, তবুও এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বিগত ২৪ বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে পাঁচগুণ। বর্তমান সরকারের ভিশন অনুযায়ী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশের মর্যাদা পাওয়ার অবস্থায় পৌঁছবে। তার মানে বাকি আছে আর মাত্র ২৪ বছর। অতীতকে যদি ভবিষ্যতের নির্দেশক হিসেবে ধরি, তাহলে পাঁচগুণের বেশি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করা যাবে না, যদি না আমরা একটা ’বিগ পুশ’ দিতে পারি। উন্নত বিশ্বের কাতারে ঠাঁই করে নেওয়ার জন্য আমাদেরকে ৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১২০০০ ডলারে উন্নীত করতেই হবে (বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী উন্নত দেশ হিসেবে কোয়ালিফাই করতে হলে কমপক্ষে ১২৪৭১ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় থাকতে হবে) অর্থাৎ মাথাপিছু আয় আটগুণ বৃদ্ধি করতে হবে এবং তা করতে হবে আগামী ২৪ বছরের মধ্যে। বর্তমান বৃদ্ধির হারে প্রয়োজনীয় প্রবৃদ্ধি ঘটাতে না পারলে উন্নত দেশের পর্যায়ে মাথাপিছু আয় উন্নীত করার জন্য লাগবে কমপক্ষে আরও ৪২ বছর। তাই বিগ পুশের জন্য প্রয়োজন হবে অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে নলেজ ইকোনমি প্রতিষ্ঠা করা, অবকাঠামোগত আমূল পরিবর্তন সাধন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর অপনোদন করা।
শিক্ষায় বিশাল উন্নতি হলেও এখনো ৬-১০ বছর বয়সী শিশুর এক-পঞ্চমাংশের বেশি লেখাপড়ায় নেই। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে শতভাগ শিশুর ভর্তির লক্ষ্য অর্জন করতে অন্তত ছয় বছর লাগবে। এডুকেশন ওয়াচের তথ্যানুযায়ী, বিদ্যমান কৌশলে সব শিশুকে প্রাথমিক স্তরে ধরে রাখতে অন্তত ৩৫ বছর লাগবে। কাজেই কৌশল বদলাতে হবে। এছাড়াও উচ্চ শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে শিক্ষা বাস্তবমুখী হয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম-উন্নয়নের রূপরেখায় গ্র্যাজুয়েটরা সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তাদের সফ্ট স্কিল বৃদ্ধি পায়, তারা যেন কর্মক্ষেত্রে যোগ্য হয়ে ওঠে। উন্নত দেশের মর্যাদা পেতে হলে শুধু মাথাপিছু আয় ১২০০০ ডলারে উন্নীত করলেই চলবে না, সাথে সাথে উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার মানউন্নয়ন করে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা জরুরি। তার জন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বর্তমানের ২.২% থেকে বাড়িয়ে জিডিপি-এর ৬% (আন্তর্জাতিক মান)-এ উন্নীত করার। শিক্ষায় (এবং স্বাস্থ্যেও) উচ্চহারে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষায় এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনে, বিশেষত গুণগত উন্নয়নের জন্য, পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা পাওয়ার জন্য শিল্পক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রচুর শিক্ষিত জনবল থাকা সত্ত্বেও শিল্প-কারখানগুলো সঠিক দক্ষ লোক সবসময় পাচ্ছে না। লোকজন শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু তাদের কর্মদক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মূলত লেখাপড়া কর্মমুখী, দক্ষতাভিত্তিক না হওয়া। দক্ষকর্মী দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় অনেক নিয়োগকারী ভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। এক হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ছয় লাখ বিদেশি শ্রমিক বাংলাদেশে কর্মরত। এরা টেক্সটাইলস, গার্মেন্টস, সিরামিকস, লেদার, ইলেক্ট্রনিকস ইত্যাদি শিল্পে নিয়োগপ্রাপ্ত। জানা যায়, এদের বেতন-ভাতা বাংলাদেশি শ্রমিকদের তুলনায় ৩/৪ গুণ বেশি। এরা বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশ থেকে পাঠাচ্ছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক সঙ্কট দূর করার জন্য পলিসি শিফ্ট অত্যাবশ্যক। দক্ষ জনবল ছাড়া উন্নত দেশ গড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সংকটের দিকেও তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। কাতার সংকট অন্যান্য এশিয়ান দেশের মতো বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করতে পারে। সেখানকার সংকট দীর্ঘায়িত হলে সেখানকার কয়েক লাখ শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে পারে, রেমিটেন্স কমে যাবে, দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কাতার থেকে এলএনজি আর হিলিয়াম আমদানি বাধাগ্রস্ত হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে উদীয়মান ইলেক্ট্রনিকস শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের প্রসারের উপর।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক