আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর বৈঠকের পর উন্মুক্ত পারস্পরিক বিরোধিতা
হুমায়ুন কবির খোকন ও আল হেলাল শুভ : নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে দলীয় এক নেতা ‘দানব’ বলা পর ওই বক্তব্যকে ‘অরুচিকর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন মন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার দলের সম্পাদকমন্ডলীর এক সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নৌ মন্ত্রী শাজাহান খানকে ‘দানব’ বলে মন্তব্য করেন। এ দিকে দলের ওই বৈঠকের আলোচনাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন, দলীয় ফোরামের আলোচনা-সমালোচনা বাইরে আসা ঠিক হয় নি। বৈঠকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর কর্মকান্ড নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। বৈঠকে একাধিক নেতা নিজ এলাকা বিবদমান দলের নেতাদের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মামলা, হামলা ও হয়রানির অভিযোগ আনেন। আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সম্পাদকম-লীর এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের ওই কেন্দ্রীয় সম্পাদকম-লীর বৈঠকে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে বলেন, মাদারীপুরের অবস্থা খুব খারাপ। শাজাহান খান সবকিছু ফ্র্রি স্টাইলে চালাচ্ছেন। মন্ত্রী দানব হয়ে উঠেছেন। তার জেলার নেতা-কর্মীরা ওই মন্ত্রীর দ্বারা নির্যাতিত বলেও জানান নাছিম। নাছিম বলেন, আমি কেন্দ্রীয় নেতা এটা উনার গাত্রদাহ। এ পরিস্থিতি চললে দলীয় পদ থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দিন।
এ বিষয়ে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, এর সঙ্গে আমি যুক্ত নই। এ অরুচিকর বক্তব্যের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। তিনি আরও বলেন, যারা কাজ করেন তাদেরই সমালোচনা হয়। আমি আমার মত কাজ করে যাচ্ছি। যারা বলার তারা বলুক এটা তাদের বিষয়। কে কি বললো এটা আমার বিষয় না। দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকের বিষয় নিয়ে বাইরে অতিরঞ্জিত আলোচনা করা ঠিক না।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাহাউদ্দিন নাছিমের ক্ষোভ প্রকাশের পর এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মাদারীপুরের বিষয়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। নাছিমকে মাদারীপুরের সমস্যা নিয়ে দলীয় সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, শাজাহান খান শ্রমিক লীগকে শেষ করে দিয়েছেন। তিনি আলাদা শ্রমিক সংগঠন করেছেন। শ্রমিক লীগের অনুষ্ঠানেও যান না।
শাজাহান খান আর বাহাউদ্দিন নাছিমের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। এ দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছে। শাজাহান খান সদর আসনের সাংসদ। বাহাউদ্দিন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কালকিনি থেকে সাংসদ হন। সেখানে আগে সাংসদ ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। গত বুধবার মাদারীপুরে শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিনের সমর্থক ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পুলিশের দুজন সদস্যসহ ১৫ জন আহত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বাহাউদ্দিন বক্তৃতা করার পর দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সমালোচনা করেন। দলের নেতাসহ অন্যদের ‘রাবিশ’ বলা এবং বাজেট নিয়ে হওয়া সমালোচনার প্রসঙ্গ তোলেন। মেজবাহ উদ্দিন অর্থমন্ত্রীর আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন সম্প্রতি। এরপর আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন কারও নাম উল্লেখ না করে একজন উপমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তার এলাকায়ও ছোট দানব আছে। দলের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও হয়রানি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার আহমদ হোসেন বলেন, আমাদের ঘরের বিষয়ে অনেক আলোচনা হয়। এ গুলো নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করা ঠিক নয়। উল্লেখ, আহমেদ হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনায়। তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হলেও দলের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করতে পারেননি।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের সমালোচনা করে বলেন, ‘ঈশ্বরদীতে তার ছেলে শিরহান শরীফকে গ্রেফতারের পর মন্ত্রী দলের অন্য নেতাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। তিনি ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদকে হয়রানি করছেন’। আবুল কালাম আজাদ মন্ত্রীর মেয়ের জামাই। কিন্তু জামাই-শ্বশুরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। এর জের ধরেই ভূমিমন্ত্রীর ছেলে শরিফ ছাত্রলীগের এক নেতার বাড়ি ভাঙচুর করেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্য পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক সূত্র জানায়, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই অভিযোগ করেন, দলের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান রংপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে রাজনীতি করছেন। তিনি দলে শৃঙ্খলা আনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে।
এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্র্রতীম সংগঠনের সঙ্গে সম্পাদকম-লীর জরুরি সভা শেষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের গণমাধ্যমের প্রতি বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক একটি দল। আমাদের ঘরোয়া গণতন্ত্র, তর্ক-বিতর্ক নিয়ে, সঠিক তথ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করুন। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের সমালোচনা আমরা করব। কেউ কেউ এমন বিষয় নিয়ে আসেন, যেগুলো তথ্য নয়। আংশিক সত্যও আসে না।
দলের মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমি কোনো নিউজ করার পক্ষে নই, গঠনমূলক সমালোচনা করলে আমরা দল হিসেবে শুদ্ধ হতে পারি। গণমাধ্যমকে আমরা শত্রু মনে করি না।
এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত দলের আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সভায় কি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এসব বিষয় বাইরে আসা ঠিক হয় নি। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবো না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, এটা দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দলের সভায় আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এটা নিয়ে কেনো বাড়িয়ে খবর তৈরি হচ্ছে।
সম্পাদনা:হুমায়ুন কবির খোকন