গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং আমাদের রাজনীতি
মোহাম্মদ আবু নোমান
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক পরিবেশে সকল দল অংশগ্রহণ করবেÑ এটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর। বাকিটুকু ভবিষ্যৎ জানে! বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই অনুমানের পথে চলেনি, সেই ধারণা থেকেই বলা যায়, আগামীতেও চলার সম্ভাবনা কম! তার অর্থ আরও রক্তারক্তি, আরও জ্বালাও-পোড়াও, সহিংসতা ও জনজীবনকে বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। বলপ্রয়োগ নয়, আলোচনায় বসতে হবে। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার এই সত্যটাই প্রমাণ করেছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, মুশতাক, জিয়া, এরশাদ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ইতোপূর্বে সকলেই বলপ্রয়োগের পর তারা হেরেছে। দেশের মানুষ তাদের দ্বিতীয়বার ভালোভাবে নেয়নি।
জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ আবশ্যক বলে মনে করেন দেশের আপামর সর্বসাধারণ। দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, ব্যবসা, শিল্প ও বাণিজ্যের কথা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনে সব দলের অংশ নেওয়া জরুরি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে হলে কেউ কারচুপি, প্রত্যাখ্যান ও ছলচাতুরির অভিযোগের সুযোগও পাবে না। ‘সালিশ মানি, কিন্তু তাল গাছ আমার’ নির্বাচন সামনে রেখে কোনো দলের এমন দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের রায়ের ওপর আস্থার সঙ্গে দেশের বৃহৎ মানুষের, বৃহৎ কমিউনিটির কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে এমন নির্বাচন জরুরি। নির্বাচনে ইসিকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারি দলের নেতারা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তার প্রতিফলন দেশবাসী দেখতে চায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগেই জয়ী হওয়ার মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। যেকোনো মূল্যে জিততে হবেÑ এমন মানসিকতা থাকলে রাজনৈতিক ব্যাকরণ হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাকরণ অনুপস্থিত। ব্যাকরণ থাকলে দেশের রাজনৈতিক মতপার্থক্য আজ এত জটিল হতো না। এছাড়া ইসিকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। গত ৪৫ বছরেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। এ কারণে নির্বাচন এলেই নানা ধরনের মতবিরোধ দেখা দেয়। বিএনপির সম্প্রতি বক্তব্যে বোঝা যায়, আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, বিএনপিকে বাদ রেখে আরেকটি নির্বাচন করা কী সরকারের পক্ষে সম্ভবও ঠিক হবে?
নির্বাচনকে ঘিরে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বর্তমান ইসি তার প্রজ্ঞা এবং গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে একজন প্রাজ্ঞ ইসি হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় উন্নীত করে নতুন আশার আলো দেখাবেন বলে আশা করছে সমস্ত বাংলাদেশ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করায় সমস্যাটি যতটা না আইনগত, তার বেশি রাজনৈতিক। কেবল যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি থাকাই যথেষ্ট নয়। কেননা দেশে সুযোগ্য লোকের অভাব কমই। কিন্তু ইসিকে স্বাধীনভাবে, সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতায় কাজ করতে দেওয়ার অভাব রয়েছে।
এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট, সামনের জাতীয় নির্বাচন কোন দিকে যাবে, সেসব বিষয় নিয়ে ইসি হিসেবে বেশ কঠিন সময় মোকাবিলাসহ ইসি স্বাধীনভাবে কতটা কি করতে পারবেন সেটাই দেখার সময়। নির্বাচনপূর্ব একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন, দেশের সংকটকালে দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দলের এক টেবিলে বসানো এবং সবরকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে একটি গঠনমূলক রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিবেশ গঠনসহ নির্বাচনকে তার স্বাভাবিক পথে চলার চ্যালেঞ্জে ক্ষমতাসীন দল ও ইসিকেই সবচেয়ে বেশি মনযোগী হতে হবে। একুশ শতকের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্যে ইসিকে ন্যায়, নিরপেক্ষ এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগামীর সেই নতুন চ্যালেঞ্জগুলো সুনিরপেক্ষভাবে এবং সকল স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে, কাউকে খুশি করার পরিবর্তে দেশের স্বার্থে করবেন বলেই জনগণ প্রত্যাশা করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেকোনো সরকারের জন্য শেষের সময়টি খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ণ হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না পেলে শেষতক রাজনীতি কোন দিকে গড়াবে, বলা কঠিন। যদিও বর্তমানের রাজনৈতিক পরিবেশ স্বস্তিদায়ক ও শান্তিপূর্ণ হলেও এই পরিবেশ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বজায় থাকবে কি না, সেটি নির্ভর করছে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা ও ইসির দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর।
ক্ষমতাসীনরা যদি সংবিধানের দোহাইয়ের গ্যাড়াকলের প্যাঁচ রেখে, লোক দেখানো আলোচনা, সংলাপের মহড়া দিয়ে, সকল সম্ভাবনা ভ-ুল করে, ভেতরে ভেতরে মানসিকতা রাখবেন ‘বিচার মানি, তবে তাল গাছটি আমার’। ক্ষমতার লোভ, স্বার্থ ও স্বৈরাচারী মনোভাবের সঙ্গে সব রসুনের গোড়া এক জায়গাতেই যদি চলে যায়, তাহলে জাতির কপালে না জানি আরও কত দুর্ভোগ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কূটকৌশলে জয়ী হলে চলবে না বরং গণতান্ত্রিক পরিবেশে, গ্রহণযোগ্য, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে জয়ী হতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান