উত্তর কাশ্মীর আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
কাশ্মীরের অমরনাথে অবস্থিত হিন্দুদের তীর্থস্থানে ভারতের গুজরাট থেকে আসা একদল তীর্থযাত্রীর ওপর গত ১০ জুলাই সোমবার সশস্ত্র জঙ্গিদের অকস্মাৎ আক্রমণ এবং তাতে সাতজন তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে উত্তপ্ত কাশ্মীরে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই ঘটনার পরপরই কাশ্মীরের সীমান্ত রেখার ওপার থেকে পাকিস্তান সেনাদের গুলিতে ভারতীয় দুজন সেনাসদস্য নিহত হওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি ১০ জুলাই হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জামায়াত-উদ-দাওয়া, যেটি সারাবিশ্বে পরিচিত লস্কর-ই-তৈয়বা নামে, যার প্রধান পাকিস্তানের নাগরিক পরিচিত জঙ্গি নেতা মাওলানা হাফিজ সাইদ। এই হাফিজ সাইদকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, যদিও তারপর থেকে এ পর্যন্ত সবার নাকের ডগার ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সর্বত্র প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাফিজ সাইদ, কেউ কিছু করতে পারছে না।
বিশ্বের তাবৎ মানুষ, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ জানেন জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, যার প্রধান হাফিজ সাইদ এবং জইশ-ই-মুহম্মদ, যার প্রধান মাওলানা মাসুদ আজাহার, এই দুই সংগঠন ও নেতা হলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আরেকটি বর্ধিত অংশ বা ঊীঃবহফবফ অৎসং, যাদেরকে পরিচালনা করেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এদের মিশন হচ্ছেÑ কাশ্মীর ও ভারতের অভ্যন্তরে চোরাগোপ্তা সশস্ত্র আক্রমণ চালানো, যাতে ভারতের সেনাবাহিনীর অনবরত রক্তক্ষরণ চলতে থাকে। উল্লেখিত দুই জঙ্গি সংগঠনের উপমহাদেশ ব্যাপি জঙ্গি তৎপরতার অনেক কাহিনী এখন সবাই জানেন। আজ আর সেদিকে যাচ্ছি না। কাশ্মীর সংকটের মূলকথায় আসি। কাশ্মীরের অবিসংবাদিত এবং আপদমস্তক অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী নেতা শেখ মুহম্মদ আব্দুল্লাহ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন কাশ্মীরে মোটামুটি একটা শান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল।
বিপুল জনপ্রিয়তা বজায় থাকা অবস্থাতেই তিনি ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর কাশ্মীরে তার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা আর আসেনি। এই ঘাটতি তো আছেই, তারপর দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কাশ্মীরের জনগণের মন জয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় কাশ্মীরের অভ্যন্তরে চরম ক্ষোভ, হতাশা ও বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়, যার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের সরাসরি পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে শুরু হয় বড় আকারের সশস্ত্র বিদ্রোহ, যার পরিণতি ও জের এখনো লেগে আছে। তারপর থেকে এ পর্যন্ত ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে, আবার কখনো নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানের পরিণতিতে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে যখন গত বছর ৮ জুলাই নবগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। তারপর থেকে কাশ্মীরের সীমান্তে পাকিস্তান-ভারতের সৈন্যদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা লেগেই আছে এবং কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে। এর একটা চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে, যখন কাশ্মীরের উরী সীমান্তে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী আক্রমণ চালিয়ে ১৮ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে। পাল্টা ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং তার জেরে দুদেশ প্রায় যুদ্ধোন্মুখ পরিস্থিতিতে উপনীত হয়। পিপল্স ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ও স্থানীয় বিজেপির নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার এখন কাশ্মীরের ক্ষমতায় আছে। ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর লম্ফঝম্ফ ও কথিত গো-রক্ষার আন্দোলনের নামে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে সেটিকে পুঁজি করার পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো এবং পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারি গোষ্ঠী। পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি ও রাজনীতির মূল উপাদান হলো চরম বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িকতা।
রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সবসময় কাশ্মীরসহ ভারতের সীমান্তে একটা যুদ্ধাবস্থা জারি রাখতে চায় এবং প্রচারণা চালায় তারা যুদ্ধ করেই ভারতের কবল থেকে কাশ্মীরকে উদ্ধার করবে। এই নীতির আওতায়ই পাকিস্তান উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান বাহিনীকে মদত দিচ্ছে আফগানিস্তানে, ভারতের অভ্যন্তরে লেলিয়ে দিচ্ছে লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহম্মদের মতো জঙ্গি সংগঠনকে এবং ওই একই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বাংলাদেশের ভূমিকে ব্যবহার করতে চায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য, যেমনটি তারা করতে চেয়েছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদে। এর মধ্যে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে চীন করিডর নির্মাণ করায় চীন-ভারত সম্পর্কেরও অবনতি হচ্ছে। সুতরাং কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ উত্তপ্ত অবস্থা এবং সেটিকে ঘিরে পাকিস্তান যে নীতি অনুসরণ করছে তা ক্রমান্বয়ে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। পাকিস্তান এখন মোল্লা ও মিলিটারির কবলে পড়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে আবেদন রেখে কোনো লাভ হবে না। তাই বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে কাশ্মীরের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান ভারতকেই বের করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক